গনিতের শুরু এবং মিসরীয় রুপকথা

শৃংখলিত মহাবিশ্ব

আমরা পৃথিবী নামকএকটা গ্রহে বাস করি। এখানে পানি আছে, শ্বাস উপযোগী বাতাস আছে। আছে বৈচিত্র্যময়প্রাণীজগত। এই গ্রহ আবার এক সৌরপরিবারের সদস্য যা কিনা আয়তনে সসীম কিন্তু আকারেঅসীম। অন্যদিকে বিশাল বিশ্ব ব্রক্ষ্ণান্ডের তুলনায় একটা বিন্দুর মতই অবস্থান এইসৌরজগতের। কি বিশাল ব্যাপার স্যাপার !! রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে তাই মানুষ সবসময়নিজের ক্ষুদ্রতাকেই উপলব্ধি করেছে।

আমরা এই পৃথিবীর মানুষেরা সাধারণত বড় কোন কাজবা দায়িত্ব এড়িয়ে চলি। কারণ যত বড় কাজ তত বেশি ঝামেলা। সেই হিসেবে একটা ধারণানেওয়াই যায় যে এই বিশাল মহাবিশ্ব আসলে বেশ এলোমেলো ভাবেই আছে। কোথাও কোন শৃংখলানেই, বাধা নেই। সৌরজগতগুলো “Survival of the fittest” অনুসরণ করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করেই টিকে আছে !!

কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, এই মহাজগত টিকে আছেকিছু নিয়ম মেনে, কিছু শৃংখল মেনে। এবং এই শৃংখল হচ্ছে গাণিতিক শৃংখল!! এই মহাজগতেরপ্রতিটা নড়াচড়া, প্রতিটা ভাঙ্গা-গড়া নিরবে গণিতকে মেনে চলছে। কিছু উদাহরণ দেওয়াযাক।

আমাদের পৃথিবী ঘুরছে তার হর্তাকর্তা সুর্যেরচারদিকে। এরকমভাবে এই সৌরজগতের সব গ্রহই ঘুরছে যার যার নিজ কক্ষপথে। এই পুরোপরিবারকে নিয়ে আবার সূর্য তার নিজের বস “মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সী” এর চারিদিকে ঘুরছে। অনেকটা কর্পোরেট “Chain ofCommand” এর মত !! তবে কর্পোরেট অফিসে বসের যেমনচিন্তাভাবনা থাকে তার অধীনস্থদের দিয়ে সব কাজ সারিয়ে নেওয়ার আর নিজে পায়ের উপর পাতুলে বসে থাকার, সেখানে আমাদের বসের বস মিল্কিওয়ে অনেক ভাল !! সে নিজেও তার সৌরপরিবার নিয়ে ঘুরছে।  এ যেন বিশালঘূর্ণনযজ্ঞ !! এই যে এত ঘুরাঘুরি, সবই কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে। এইনিয়মগুলো আবার একটি বা দুটি গাণিতিক নিয়মেই আটকে ফেলা যায় !! এবং নিয়মগুলো সেভাবেইগড়ে উঠেছে যেভাবে গড়ে উঠলে আমাদের জন্য ভালো হয় !! এই পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার।এর একটু এদিক সেদিক হলেই আমাদের পক্ষে আর পৃথিবীতে থাকা সম্ভব হত না। অন্যদিকেউপবৃত্তও নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলে। এর বাইরে গেলে তার পক্ষে আর উপবৃত্ত হয়েথাকা সম্ভব হয় না। গণিতের শিকলে বাধা যেন সবই !!

পৃথিবীর ভিতরেই, আমাদের আশেপাশে তাকালেও আমরাসব কিছুতেই গণিত খুঁজে পাবো। সাগরের ঢেউয়ে, বাতাসের দাম্ভিকতায়, পাখিদের কলতানে,ঝরে পরা পাতায়- সব কিছুতেই। প্রতিটা মহাসাগরের ঢেউ যত ডিগ্রী কোণে আবর্ত হয় তারএকটু এদিক-সেদিক হলেই ঘূর্ণিঝড় হয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়। তারা নিজেরা গণিতের কিছুনিয়ম মেনে চলে। আবার প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের সাথে আটলান্টিকের ঢেউয়ের কোন মিলনেই। তাদের প্রত্যেকের নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবহার আলাদা।

  আবার সাগরের ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করে এই পৃথিবীরবাতাস। কিন্তু এই বাতাসও যে বন্দী। এমনিতে বাতাসের বয়ে চলা দেখলে মনে হয় তারা যেনস্বাধীন, উচ্ছৃংখল। আসলে বাতাস চলে তাপমাত্রা মেনে। তাপমাত্রা যত বেশি বাতাস ততমুক্ত, তত উত্তপ্ত। তাই বেশভুষায় যতই স্বাধীন হোক, আসলে তারা পরাধীন। তাদেরনিয়ন্ত্রক তাপমাত্রাদের প্রভু হচ্ছে কিছু গাণিতিক নিয়মকানুনের উপর ভিত্তি করে গড়েওঠা পদার্থবিদ্যার কিছু থিওরি !!

 

তাই মানবজাতি সৃষ্টির শুরু থেকেই গণিতের হাতেবন্দী। এই বন্দিত্ব অবশ্য অনেক মধুর। কারণ এই বন্দীদশা তাদেরকে সকল প্রাকৃতিকবিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে আসছে। যখন থেকে মানুষ তাদের এই চিরন্তন বন্দীদশাকেউপলব্ধি করতে পেরেছে তখন থেকেই সে চেস্টা করে যাচ্ছে এই বন্দীদশাকে ব্যাখ্যা করার,এর থেকে সর্বোচ্চ ফায়দা উঠানোর। এবং এভাবেই একদিন গণিতের জন্ম হল।

এবং পথ চলাশুরু

গণিতের কাছে বন্দীমানুষ একসময় বন্দীদশার রহস্য উদঘাটনের জন্য উঠে পড়ে লাগল। একের পর এক প্রতিভাধরমানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে উঠতে থাকল আজকের গণিতের ভিত্তি। এই ভিত্তিস্থাপনেরমহাযজ্ঞে সর্বপ্রথমেই আসে মিসরীয়দের নাম।

বড়ই আজব জাতি এই মিসরীয়রা।  প্রাচীন অনেক সভ্যতার মতই তাদের অনেক অদ্ভুতরীতিনীতি ছিল। সে মিসরীয় সমাজে “মৃত্যু” ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মৃত ব্যক্তির বিদেহীআত্না যেন অনন্তকাল থাকতে পারে তাই নিয়ে ছিলো তাদের যাবতীয় আয়োজন। এতে সবচেয়ে বেশিএগিয়ে ছিলো মিসরীয় রাজবংশ ফারাওরা। তারা নিজেদের জন্য তৈরি করেছিলা বিশাল বিশাল Tomb, যেগুলোকে আমরা পিরামিড হিসেবে চিনি। এই পিরামিড হচ্ছেমানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম বিস্ময়কর এক সৃষ্টি। এত বছর আগে কেউ আধুনিক সবযন্ত্রপাতি ছাড়াই এমন স্থাপনা তৈরি করতে পারে- এটা ভাবতেই গা শিরশিরিয়ে ওঠে। তবেএই বিশাল পিরামিড তৈরির মুল রহস্য কিন্তু “গণিত”। ভুমি পরিমাপেরধারণার জন্মই হয় তখন। আর শুধু গণনার বাইরেও যে গণিতের আরও অনেক ব্যবহার আছে, এটাপ্রথম মিসরীয়রাই দেখিয়েছে। ব্যাপারটাকে অনেকটা এভাবে বলা যায় যে, আজকের যুগের যে আধুনিক “Applied mathematics” আমরা দেখি তারগোড়াপত্তন হয় মিসরে।

হায়ারোগ্রফ্লিক্সঃ

মিসরীয়দেরকথা আসলেই প্রথম যে কথাটা মাথায় আসে তা হচ্ছে “হায়ারোগ্রিফ্লিক্স”- অদ্ভুত কিছু চিহ্ন যেগুলো ব্যবহার করে মিসরীয়রানিজেদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গেছে। এগুলোর বেশিরভাগই গণনার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।

খোদ আধুনিক মিসরেইএই “হায়ারোগ্রিফ্লিকস” abundant ছিলো১৭৯৯ সাল পর্যন্ত। ঐ বছরই আলেক্সান্দ্রিয়ায় “Rosetta Stone” আবিষ্কার হয়। আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে কিছু দূরে,উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত শহর “Rosetta” (যারঅর্থ “রশিদ”)। এখানেই ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি বাই ২ ফুট ৪ ইঞ্ছির এই কালোব্যাসল্ট পাথরটি পাওয়া যায়।

ই পাথরে লেখাকথাগুলো ছিলো দুটি ভাষার- মিসরীয় আর গ্রীক। এই মিশ্র ভাষার অনুবাদ করতে যেয়েই মূলত“হায়ারোগ্রিফ্লিক্স” এর পাঠদ্ধারের মুলনীতিগুলো আবিষ্কার হয়। এই পুরোকর্মযজ্ঞের পিছনে মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বিখ্যাত মিসরীয় গণিতবিদ টলেমি। এবং প্রাথমিকপর্যায়ে থাকা এই অনুবাদের কাজকে পরবর্তীতে এগিয়ে নিয়ে যান ThomasYoung (1773-1829) এবং JeanFrancis Champollion (1790-1832)। এখানে আমাদেরআরেকজন পরিচিত গণিতবিদের নামও চলে আসে যার নাম Jean Baptiste Joseph Fourier, যিনি নাকি Champollion কে উৎসাহ দিয়েছিলেন মিসরীয় সভ্যতা নিয়ে পড়াশুনা করারজন্য।

“Rosetta Stone” অনুবাদের কাজটি শেষ হয় Champollion এর হাতে। তিনিই প্রথম বলেন যে পাথরে থাকা চিহ্নগুলোস্রেফ কিছু পাগলের আঁকিবুঁকি না। তার মতে “Rosetta Stone” এর আসল ভাষা হচ্ছে গ্রীক আর হায়ারোগ্রিফ্লিক্স হচ্ছে এইগ্রীক ভাষার অনুবাদ!!

হায়ারোগ্রফ্লিক্সের সবচেয়ে অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যহচ্ছে এটাকে “বাম থেকে ডান” কিংবা “ডান থেকে বাম” -যেকোনভাবেই পড়া যায়। হায়ারোগ্রিফ্লিক্স কিন্তু মিসরীয়সাধারণ জনগণের ভাষা ছিলো না !! শুধুমাত্র ধর্মীয় এবং সরকারী কাজে। তাই সেই যুগে “হায়ারোগ্রিফ্লিক্স” কে বলা হত “ঈশ্বরের ভাষা”।

মিসরীয় বর্ষপঞ্জিঃ

আগেই বলেছি মিসরীয়দের জীবনাচরণে “ধর্ম” ছিলো খুবইগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্মীয় উৎসবের সঠিকহিসাব রাখার জন্য তারা একটা বর্ষপঞ্জি বানায়। তাদের বর্ষপঞ্জিতে এখনকার মতই ১২মাসে বছর হত আর মাস ছিলো ৩০ দিনের এবং সাথে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৫ দিন ছিলো উৎসবেরজন্য।

 

 

আমরা যেভাবে মিসরীয় গণিত সম্পর্কে যেভাবে জেনেছিঃ

আমরা মানে আধুনিক মানুষদের মিসরীয় গণিত সম্পর্কে জ্ঞানেরমূল উৎস “হায়ারোগ্রিফ্লিক্স” আর “প্যাপিরাস”। হায়ারোগ্রিফ্লিক্স খোদাই করা ছিলো হাজার হাজার মিসরীয়উপাসলানয়ে। অন্যদিকে মিসরীয় গণিত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এমন প্যাপিরাসের সংখ্যামাত্র ২টি।

Rhind mathematical papyrus: খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৫০ সালের এই প্যাপিরাসটি সংগ্রহ করেন A.H.Rhind। ১৮ ফুট লম্বা এবং ১৩ ইঞ্চি প্রস্থের এই প্যাপিরাসটি “Ahmes Papyrus” নামেও পরিচিত।

Moscow mathematical papyrus: খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ সালের এই প্যাপিরাসটি সংগ্রহ করেন V.S.Golenishchev।

প্যাপিরাস ছিলো মিসরের একমাত্র লেখার উপাদান। নিলনদের তীরে জন্ম নেওয়া প্যাপিরাস বৃক্ষ থেকে তৈরিবলে এর নাম “প্যাপিরাস”। এই পর্যন্ত মরুভূমি থেকে, Tomb থেকে বহু প্যাপিরাস উদ্ধার হয়েছে।

এভাবেই অসীমের পথে পথ চলা শুরু হয় গণিতের।

 

Md. Noor Faizur Reza
Author: Md. Noor Faizur Reza

আমার যে কাজ ভালো লাগে তা নিয়ে সারাদিন পরে থাকি !

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/rezanur/432/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

2 comments

  1. ভাই,আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,এতসুন্দর তথ্যবহুল একটা পোস্ট দেয়ার জন্য।

    1. আপনাকেও ধন্যবাদ। 🙂

মন্তব্য করুন