গণনাযন্ত্রের ইতিহাস – “অ্যাবাকাস”

বর্তমান যুগে সংখ্যার ধারণা ব্যাতিত গণনা করার কথা চিন্তারও বাইরে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন লিখিত সংখ্যা ধারণার উৎপত্তি হয়নি। তখন গণনা করার জন্য মানুষ হাত এবং হাতের আঙ্গুল এর সাহায্য নিত। যখন ১০ ( দুই হাতে সর্বোচ্চ আঙ্গুলের সংখ্যা ) এর অধিক পরিমাণ গণনা করার প্রয়োজন হল তখন মানুষ বিভিন্ন নুড়ি পাথর কণা, গাছের বাকল, পশুর হাড় প্রভৃতি ব্যাবহার করে গননার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো।

nam_count_fig_1

ধীরে ধীরে মানব সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে বিভিন্ন ব্যাবসা-বাণিজ্যের কাজে গণনার প্রয়োজন বৃদ্ধি পায়। বণিকদের ক্রয় এবং বিক্রয় এর হিসাব রাখা অথবা পণ্যের দাম নির্ধারণ করা প্রভৃতি কাজে ক্রমে সহজে গণনা পদ্ধতির প্রয়োজন উপলদ্ধ হয়। সংখ্যা আবিষ্কারের আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিদিনকার কাজে বিভিন্ন গণনা যন্ত্রের ব্যাবহার বৃদ্ধি পায়। অ্যাবাকাস এমনি একটি গণনা যন্ত্র যার মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট গণনা পদ্ধতির সাহায্য বাদেই গণনা করা যায়।

 

গণনা যন্ত্র বা ক্যাল্কুলেটার বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি তা হল এমন একটি যন্ত্র যা বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে দিতে সক্ষম। কিন্তু আদিম যুগে ব্যাবহৃত এসকল গণনা যন্ত্র মুলত গণনার সময় বিভিন্ন সংখ্যা মনে রাখার কাজে ব্যাবহৃত হতো। ব্যাপারটা এমন যে মানুষ নিজেই যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ প্রভৃতি সমস্যার সমাধান করতো এবং বিভিন্ন সংখ্যা নির্দেশ করার জন্য ব্যাবহার করতো এ সকল যন্ত্র। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এ সকল যন্ত্রের উন্নতি সাধিত হয় এবং আরও বৃহৎ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে ব্যাবহৃত হয়।  যিনি অ্যাবাকাস ব্যাবহারে পারদর্শী তাকে বলা হয় অ্যাবাসিস্ট।

 

ঠিক কখন থেকে এবং কোন সভ্যতা এ সকল যন্ত্রের ব্যাবহার শুরু করে তা নিয়ে প্রচুর মতবাদ রয়েছে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের মতে  মধ্য এশিয়ার চৈনিক সভ্যতায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ শতকের দিকে এর প্রথম সূচনা ঘটে। পরবর্তীতে বাণিজ্যের খাতিরে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০-২৩০০ সময়কালে প্রথম অ্যাবাকাস যন্ত্রের উল্লেখ মিলে ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। অনেক ইতিহাশবিদ বিভিন্ন ব্যাবিলনীয় লিপির কথা উল্লেখ করেন যেখানে অ্যাবাকাস এর ব্যাবহার এর কথা উল্লেখ আছে। গ্রীক ইতিহাশবিদ হিরোডোতাস মিশরীয় সভ্যতায় এর ব্যাবহার উল্লেখ করেন যেখানে এটিতে গণনা করা হত গ্রীক অ্যাবাকাস এর বিপরীত পদ্ধতিতে (ডান থেকে বামে), ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ শতকে গ্রীক সভ্যতায় অ্যাবাকাস প্রচলিত ছিল যা অ্যাবাকি লিপিফলক (Counting Board) নামে পরিচিত। এ ধরনের অ্যাবাকাস ছিল মুলত ব্রোঞ্জ নির্মিত লিপিফলক।[১] লিপিফলকটি খাঁজকাটা ছিল। গোলাকৃতির গুটিগুলি গড়িয়ে যেতে পারত। এ ধরনের অ্যাবাকি এক ধরনের বহনযোগ্য টেবিল এর উপরে নির্মিত হত যেন গণনায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে স্থান পরিবর্তন করা যেত। গ্রীক দ্বীপপুঞ্জ সালামিস এ ১৮৪৬ সালে এরকম একটি টেবিল আবিষ্কৃত হয় যা ব্যাবহৃত হত খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ শতকে।  এটিই আবিষ্কৃত সবচে পুরোনো অ্যাবাকাস যা ‘সালামিস এর টেবিল’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

 

পরবর্তীতে রোমান সমাজে ‘ক্যালকুলি’ (Calculi) নামক রোমান অ্যাবাকাস পরিলক্ষিত হয়। এতে দুই ভাগে আটটি করে খাজ কাটা থাকতো। নীচের খাঁজগুলো ছিল বৃহৎ যাতে সর্বাধিক পাঁচটি করে গুটি থাকতো এবং উপরের খাঁজগুলো ছিল তুলনামূলক ছোট যাতে সর্বাধিক একটি গুটি থাকতো। মুলত এর আকৃতি রোমান সংখ্যা পদ্ধতির উপর গড়ে উঠেছিল।

 

অতঃপর খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনদেশের সাহিত্যে অ্যাবাকাস ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগপর্যন্ত চীনদেশে অ্যাবাকাস তেমন ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়নি। রোমান অ্যাবাকাস এবং চৈনিক অ্যাবাকাসের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ছিল। চৈনিক অ্যাবাকাসে গুটিগুলি তারের উপর লাগানো থাকত। চীনে অ্যাবাকাসকে ‘সুয়ান পান’ (SuanPan) বলা হয়।

মুলত সাতটির অধিক পাতলা লৌহ দণ্ড দ্বারা তৈরি করা হয় এই যন্ত্রটি যা একটি আড়াআড়ি কাঠের দ্বারা দুইভাগে ভাগ করা থাকে। উপরের অংশে থাকে দুটি করে এবং নিচের অংশে থাকে পাঁচটি করে গুটি। সুয়ান পান এর আকৃতি ২/৫-অ্যাবাকাস এর মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। অপেক্ষাকৃত গোলাকৃতির কাঠের তৈরি মসৃণ এ সকল গুটি উপর নিচ করে গণনা করা হতো।

 

পরবর্তীতে জাপানে উনবিংশ শতাব্দীতে আরেকটি সরলাকৃতির অ্যাবাকাস পরিলক্ষিত হয় যা ‘সরোবান’ (Soroban) নামে পরিচিত।এই অ্যাবাকাস এর সাথে বর্তমানে সর্বস্থানে প্রচলিত অ্যাবাকাস এর সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। কাঠের ফ্রেমে পাতলা লৌহ দণ্ড দ্বারা তৈরি করা হয় এই যন্ত্রটি যা একটি আড়াআড়ি কাঠের দ্বারা দুইভাগে ভাগ করা থাকে। উপরের অংশে থাকে একটি করে এবং নিচের অংশে থাকে পাঁচটি করে গুটি থাকে। সরোবান এর আকৃতি ১/৫-অ্যাবাকাস এর মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। পরবর্তীতে কোরিয়া দেশে এটির ব্যাবহার বিস্তার লাভ করে এবং সেখানে ‘যূপান’ (Jupan) নামকরণ হয়।

 

রাশিয়ায় ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ‘ শ্বটা ’ (Schoty) নামক একটি অ্যাবাকাস যন্ত্রের প্রচলন আছে যেখানে আড়াআড়ি ভাবে ১০টি গুটি কয়েকটি পাতলা লোহার দণ্ডের মধ্যে অবস্থান করে এবং বাম থেক ডান দিকে গণনার কাজে ব্যাবহৃত হয়। এছারাও মেসোমেরিকান সভ্যতা (বর্তমান মেক্সিকো) এবং প্রাচীন ইনকা সভ্যতার অ্যাবাকাস এর ব্যাবহার নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে।

 

বিভিন্ন ধরনের অ্যাবাকাস এর ব্যাবহারবিধি বিভিন্ন রকম। খাজ অথবা দণ্ডের সংখ্যা এবং প্রত্যেকটিতে গুটির সংখ্যার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন অ্যাবাকাস এর গণনা পদ্ধতি ভিন্নতা লাভ করে।

 

একটি সুয়ান পান (চৈনিক অ্যাবাকাস) এর উপরের অংশে অবস্থিত গুটির প্রত্যেকটির মান পাঁচ। এবং নিচের অংশে অবস্থিত পাঁচটি গুটির প্রত্যেকটির মান এক করে ধরা হয়। মাঝখানে অবস্থিত কাঠের বীম এর সাথে সংযুক্ত গুটির মানের মাধ্যমে সংখ্যা নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ প্রথম লৌহ দণ্ডে উপরের ১টি গুটি ও নিচের ২টি গুটি যুক্ত থাকলে তার মান হবে (১X৫+২X১)=৭, এখানে প্রথম দণ্ড দ্বারা একক, দ্বিতীয় দণ্ড দ্বারা দশক, তৃতীয় দণ্ড দ্বারা শতক এভাবে ১০ ভিত্তিক সংখ্যা ব্যাবস্থার মাধ্যমে গণনা করা হয়। তাই ২৭০৯১ সংখ্যাটি নির্দেশ করতে নিম্মলিখিত আকারে অ্যাবাকাসটি সাজাতে হয়।

 

অ্যাবাকাস এর ব্যাবহারের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও এখনও বিভিন্ন দেশ যেমন আফ্রিকার অনেক স্থানে গণনার কাজে অ্যাবাকাস ব্যাবহৃত হয়। এর মাধ্যমে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ এর পাশাপাশি বর্গমূল , ঘনমূল প্রভৃতি জটিল গাণিতিক সমস্যাও সহজে সমাধান করা যায়। চীন এবং জাপানে শিশুদেরকে ছোটবেলায় অ্যাবাকাস এর মাধ্যমে গণনার প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। ধারণা করা হয় এর মাধ্যমে গণনা করা শিখলে শিক্ষার্থীরা যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ প্রভৃতি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারদর্শিতা লাভ করে। সংখ্যার ধারণা স্বচ্ছ করা এবং গাণিতিক কল্পনাপ্রতিভা বৃদ্ধিতে অ্যাবাকাস গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এছারাও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ‘ক্রেনমার অ্যাবাকাস’ (Cranmer Abacus) তাদের শিক্ষাচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে।

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/arifin/403/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

2 comments

  1. হেহেহে। প্রথম পোস্টে কমেন্ট করলাম :p

  2. এই জিনিসটা দিয়ে আসলে গুনে কিভাবে ?
    মাঝখানে “নিম্নলিখিত” লেখাটার পরে কিছু আছে নাকি ?

মন্তব্য করুন