উপলব্ধি

লেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা এবং ঘটনাচক্রের সমন্বয়হীনতা থাকলে তার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । লেখার মান যাই হোক না কেন এটা জীবনের বাস্তবতা থেকেই নেয়া । তাই সৌন্দর্য না থাকলেও অগুরুত্বপূর্ণ নয় ।

আমার নিজের কিছুটা পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন প্রথমেই অনুভব করছি । মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি । বেশ বড় থেকে এখানে মানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এসেছি । বেশ বড় মানে বে………….শ বড় । আমরা ছয় ভাই এবং চার বোনের বিশাল পরিবার । বাবা-মা সহ একজন অতিরিক্ত খেলোয়াড় সহ ফুটবল দল হয়ে যায় । বাবা চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচারী ছিলেন । যে কারনেই হোক তিনি অবৈধভাবে উপার্জন করেন নি, যেটা অবশ্যই এখন আমার জন্য গর্বের । সুতরাং বুঝতেই পারছেন এত বিশাল পরিবার পরিচালনার গুরু দায়িত্ত্ব আমার মা এবং বড় ভাইদের উপর পড়ে । বলতে ভুলে গিয়েছি আমি পরিবারের কনিষ্ঠতম । আমার মা এবং বড় ভাইদের উপর দিয়েই মুল ঝড়টা বয়ে যায় । আমি ছোট থাকায় আঁচটা টের পাইনি, তবে দেখেছি । এখন আমার পরিবার প্রতিষ্ঠিত ।

 

পরিবারের গল্প থেকে নিজের দিকে আসি । লেখাপড়ার গড় পড়তা থলেও কোন অজ্ঞাত কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই । গণিত আমার নির্বাচন ফর্মে মাঝের দিকে ছিল । অবশ্য ইচ্ছা ছিল যে বিষয়ই পাইনা কেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব । এক ধরণের অদ্ভুত ভালবাসা আর মোহ নিয়েই অন্য সবার মত এখানে ভর্তি হই ।

 

মোহ ভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি । আমি প্রথম থেকেই হলে থেকেছি । সুতরাং যারা বাসায় থাকে মেসে থেকেছে তাদের সম্পর্কে আমি খুব ভাল বলতে পারবনা । যাই হোক হলে সিট পাওয়ার প্রক্রিয়া এবং থাকার পরিবেশ হলে অবস্থাঙ্কারী সবারই জানা । বাইরে যারা থাকেন তারা আমার আলোচ্য বিষয় নয় । আমার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল আমার অগ্রজ হলে থাকায় গণরুমের ধকল আমাকে পোহাতে হয়নি । তবে মিছিল-মিটিং কম করতে হয় নি ।

এবার আসি মূল বিষয়ে, আমার অতি প্রিয় (!!!!) “Department of Mathematics”

 

স্বপ্নে বিভোর মন আর দুরুদুরু বুক নিয়ে ডিপার্টমেন্টে যাই । প্রত্যেক শিক্ষক এসেই এক কথা বলে গেলেন, “তোমরা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক খুব ভালো ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছ । এখান থেকে পড়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার হওয়া যায় । আর ব্যাংকে তো প্রচুর ছাত্র চাকরি পাচ্ছে”, সাথে যোগ করলেন এখান থেকে কি কি বৃত্তি দেয়া হয় । হতাশ হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া সত্তেও উনার এমন কোন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কথা বলতে পারলেন না, যাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারি । বিখ্যাত কোন গণিতবিদ কিংবা গণিতের ব্যাপকতা নিয়েও কোন সুন্দর ও স্বচ্ছ ধারণা দিতে ব্যর্থ হলেন । ব্যর্থ হলেন বললাম তার কারণ হচ্ছে আমি মোটেই অনুপ্রাণিত বোধ করি নি ।

 

ক্লাস চলতে থাকলো । মাঝখানে নবীন বরণ হল । পড়াশুনার দিকে খেয়াল না থাকলেও ক্লাস নিয়মিত করতাম । ক্লাসে কিছুই বুঝতাম না । এর কারন পড়ে বুঝতে পারি । আমাদের ব্যাচ থেকেই মূলত প্রথম ইনকোর্স ও গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়। ফলে বিষয়টা নিয়ে আমাদের সবার ধারণা ছিল না ।

 

আলাদা আলাদা খাতায় লেকচার তোলা বা লেকচার গুলো সাজিয়ে নোট করার প্রয়োজনীয়তা কখনই মাথায় আসে নি। প্রথম দিকে মনে হত ভাল রেজাল্ট করা

বুঝি খুবই সহজ কোন বেপার হবে। কিন্তু ইনকোর্সের রেজাল্ট  দেয়া শুরু হলে ভুল ভাঙ্গতে শুরু করে । যেহেতু ইনকোর্সের জন্য পরিশ্রম করি নি, তাই খারাপ ফল আমাকে পড়ার টেবিলে বসাতে পারে নি। ভেবেছি ফাইনাল তো আছেই । ফাইনালে ঠিকই দেখিয়ে দিব!!! কিন্তু  ফাইনাল পরীক্ষাও একই ভাবে দিলাম । টেনেটুনে পাশও করলাম । তবে কোন কিছুতেই বোধোদয় ঘটছিল না । কোনভাবেই পড়ালেখার দিকে মন দিতে পারিনি, আগ্রহ জন্মায়ই নি কখনই । দ্বিতীয় বর্ষ টাও একই ভাবে গেল । ফাইনাল পরীক্ষা আরও খারাপই হল । পাশের আশাই ছড়ে দিয়েছিলাম । ফলে তৃতীয় বর্ষে ক্লাসে অনীহা শুরু হল । পড়াশুনা থেকে দূরে সরে আসি । একই সময়ে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে । যাই হোক দ্বিতীয় বর্ষেও কোনভাবে পাশ করে তৃতীয় বর্ষে উঠি । কিন্তু এবার বধহয় খুব বেশিই পিছিয়ে পড়েছিলাম । কিছু ইনকোর্সে অংশগ্রহন করিনি । শরীর, মানসিক দুই দিক থেকেই পিছিয়ে পড়ি অনেক বেশি । সিদ্ধান্ত নেই রিঅ্যাডমিশন নিব । এখান থেকেই ভয়াবহ জীবনের শুরু ।

 

যেহেতু সিদ্ধান্ত নেই পুনঃভর্তি হব তাই হাতে আর তেমন কাজ থাকল না । বন্ধুর তৃতীয় বর্ষ ফাইনালের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আর আমি ছিলাম অফুরন্ত অবসরে । আর তখনই বুঝতে পারলাম, যার নির্দিষ্ট কোন কাজ থাকে না সে থাকে সবচেয়ে ব্যস্ত । যেকোন অযাচিত কাজের জন্য তার নাম চলে আসে সবার আগে । আমার মত একই অবস্থায় আছে, এমনদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয় হয় । তাদেরও মানসিক অবস্থা আমার ব্যতিক্রম নয়।

 

রিঅ্যাডমিশন নেয়ার যে প্রক্রিয়া এবং তার জন্য যে হ্যাপা পোহাতে হয় তার সাথে সম্যক পরিচয় হল । নতুন ক্লাসমেটদের সাথে ভালভাবে সাজিয়ে নিতে পারছিলাম না । আরও ক্লাস বিমুখ হয়ে পড়ি । রোল নং না থাকার কারণে প্রায় প্রতি ক্লাসেই টিচার  দাড় করিয়ে কথা শোনাতেন । যার প্রভাবটা অবশ্যই নেতিবাচক ছিল । ইনকোর্সে অংশগ্রহণ করি অনিয়মিতভাবে এবং অপ্রস্তুতভাবে । দেখতে দেখতে চলে আসে ফাইনাল পরীক্ষা । প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে থেকে পরীক্ষা দিতে থাকি । একটা পরীক্ষা দেই, আর সেটার গ্রেড  কি হবে, সিজিপিএ কি হবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে শেষমেশ হতাশাই হয় একমাত্র সঙ্গী । শেষ দুইটি পরীক্ষা দেয়ার ধৈর্য্য আর রাখতে পারিনি । আবার থার্ড ইয়ার !!!

 

 

এইবার রিঅ্যাডমিশন নেয়াটা হয়ে পড়ে আরও দুস্কর। নিত্য নতুন নিয়ম আর শিক্ষকদের সেটার ব্যাপারে অজ্ঞতা বিষয়টাকে আরও জটিল করে তোলে। সৃষ্টি হয় প্রচন্ড মানসিক চাপ। আসলে এই সময়টাই সবচেয়ে কঠিন হয়ে দেখা দেয়। সব দিক থেকে চাপ। ব্যাচের সবার অনার্স শেষ, আমি মাত্র থার্ড ইয়ার-এ। পরিবারের, প্রতিবেশিদের চাপের কথা তো বাদই দিলাম । দাঁতে দাঁত চেপে পরীক্ষায় অংশ নেই। বিস্বয়কর ভাবে পাশও করে যাই।

 

ফোর্থ ইয়ার  টা কঠিন মনে হয়নি। যদিও অনার্স ডিগ্রি পাওয়ার জন্য ফোর্থ ইয়ারে আমাকে একটা নির্দিষ্ট সিজিপিএ পেতে হয়েছিল। তাই আর পিছনে তাকাই নি।

 

এবার আসি বর্তমানে যারা আমার অতীত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য কিছু কথায়।

প্রথমেই আসি, যারা এক বা একাধিকবার পুনঃভর্তি হয়েছে তারা কি এখানে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চায় কি না বা এটা ছাড়া তাদের অন্য কোন অপশন  আছে কি না। যদি অপশন  থাকে সেই অপশনটা নেয়ার সাহস ও শক্তি আছে কি না। যদি থাকে তাহলে সেই চ্যালেঞ্জ টা নেয়া যেতে পারে, তবে অবশ্যই অতীতের শিক্ষাটা ভুলে যাওয়া চলবে না।

 

আর যাদের অপশন নাই তাদেরকে একটা কাজ অবশ্যই করতে হবে, তা হল যে কোন ভাবে হোক  ডিপার্টমেন্ট টাকে ভাল লাগতে হবে। যেভাবেই হোক, হয় ক্লাসমেট দের সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করে অথবা ডিপার্টমেন্ট-এর নবীনবরন বা পিকনিক  এ অংশ নিয়ে অথবা সম্ভব হলে কোন টিচার এর সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করে । রেগুলার ব্যাচের ভাল কোন শিক্ষার্থীর সাথে ভাল সম্পর্ক থাকলে খুব সুবিধা হয়ে যায়। ডিপার্টমেন্ট-এর খোঁজ খবর থেকে লেকচার, নোট সবই পাওয়া যাবে।

 

নিজেকে বেশি প্রাধান্য দেয়া শুরু করতে হবে। নিজেকে প্রাধান্য দেয়া বলতে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া। অন্যের কোন কাজের জন্য নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করা যাবে না। একটা উধারণ দেই, আপনি মুভি দেখছেন এবং সেটা উপভোগ করছেন। এমন সময় যদি আপনার বন্ধু বলল শপিং-এ যাবে। এক্ষেত্রে আপনি তাই করবেন যা আপনার চায়। চাপে পড়ে হ্যা বলবেন না। প্রথম দিকে বেশ কঠিন মনে হলেও মানুষ পরিষ্কারভাবে না বলতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ন। নিজের কোন ছোট্ট সাফল্যেও সম্ভব হলে নিজেকে পুরষ্কিত করতে পারলে ভাল লাগবে।

 

অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গ থেকে সরিয়ে ডিপার্টমেন্ট ও পরাশুনা রিলেটেড  বন্ধুদের সাথে বেশি সময় ব্যয় করার চেষ্টা করতে হবে। বুদ্ধি খাটিয়ে চেষ্টা করতে হবে যেন সময় টা বোরিং  না কাটে। একটা ভাল গ্রুপ তৈরি করে নেয়াটাই আসলে মূল উদ্দেশ্য যারা পরীক্ষার সময় একসাথে পড়তে পারবে। সম্ভব হলে একসাথে কোথাও বেড়াতে বা খেতে যাওয়া বেশ ভাল কাজে দেয়।

 

একটা কথা সব সময়ই মাথায় রাখতে হবে সময় খুব কম এবং তা অপচয় করা যাবে না। যতটা সম্ভব নিজের জন্য সময় দিতে হবে। নিজের পড়ার জন্য, নিজের গল্প করার জন্য, নিজের মুভি দেখা বা গান শোনার জন্য, নিজের বেড়ানোর জন্য। কখনই অন্যের চাপে পড়ে নিজের ভাল না লাগলেও সেই কাজ করা যাবে না।

 

ভাল কোন অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে ভাল হয়। সবচেয়ে ভাল হয় যদি খেলাধুলা বা সাঁতার কাটা বা সাইকেল চালানো এই ধরনের কিছু করা যায়। এটা মন ভাল রাখতে খুব ভাল কাজে দেয়।

 

এগুলো আমি বললাম আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। অবশ্যই অন্যদের অন্যরকম উপলব্ধি থাকবে।

 

যারা এখন প্রথম বর্ষে আছ, তাদের জন্য বলব, যদি একই ডিপার্টমেন্ট-এর পড়, তাহলে প্রথম থেকেই চেষ্টা করতে হবে যে ডিপার্টমেন্ট টাকে ভাল লাগে। তোমরা আমার চাইতে অনেক আধুনিক। আমার চাইতে অনেক  ভালভাবেই যাও কিভাবে ডিপার্টমেন্ট-কে ভাল লাগাতে হয়।

 

সবশেষে একটা কথা বলি, আমি যেমন বললাম তেমন অনেকেই অনেক কথা বলবেন। আপনারা সেটাই গ্রহণ করবেন যেটা আপনার বিবেক, বিচার-বুদ্ধি বলে। এমন কিছু গ্রহণ বা অনুসরণ করবেন না যাতে শেষে অন্যকে দায়ী করার প্রয়োজন পড়ে।

 

 

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/sakib/771/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

6 comments

Skip to comment form

  1. ভালো লাগল সাকিব। আমি জানি না তুমি বর্গমূলে আইডি খুলছ কিনা তবে তোমার কাছ থেকে আরো লেখা চাচ্ছি ভাই।

  2. এত সুন্দরভাবে মনের দু:খ গুলো সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন ভাই।

    আমরা চাই আর যেন কোন দ্বিতীয় সাকিব বা অন্য কেউ কখনো আর গণিতের যাতাকলে পড়ে এভাবে তার দুখের কথা আমাদের কাছে তুলে ধরে

    ধীক এই অনার্স শিক্ষাব্যাবস্থায় গড়ে দেয়া সিজিপিয়ের দেয়াল ধীক তোমায়

  3. আমার ও তো একই অবস্তা ……………।
    যাই হোক লেখাটা ভালো লাগলো ।

  4. এত সুন্দরভাবে মনের কথাগুলো সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন ভাই , পড়ে খুব ভাল লাগলো…

  5. ” হতাশ হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া সত্তেও উনার এমন কোন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কথা বলতে পারলেন না, যাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারি । বিখ্যাত কোন গণিতবিদ কিংবা গণিতের ব্যাপকতা নিয়েও কোন সুন্দর ও স্বচ্ছ ধারণা দিতে ব্যর্থ হলেন । ব্যর্থ হলেন বললাম তার কারণ হচ্ছে আমি মোটেই অনুপ্রাণিত বোধ করি নি । ”

    কথাগুলো আমার ক্ষেত্রেও খুব বেশী সত্য… 🙁

  6. ” হতাশ হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া সত্তেও উনার এমন কোন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কথা বলতে পারলেন না, যাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারি । বিখ্যাত কোন গণিতবিদ কিংবা গণিতের ব্যাপকতা নিয়েও কোন সুন্দর ও স্বচ্ছ ধারণা দিতে ব্যর্থ হলেন । ব্যর্থ হলেন বললাম তার কারণ হচ্ছে আমি মোটেই অনুপ্রাণিত বোধ করি নি । ”

    কথাগুলো আমার ক্ষেত্রেও খুব বেশী সত্য… 🙁

মন্তব্য করুন