হ্যাঁ লাল বাস, এই বাস বলতে একপ্রকার দ্বিতল যানকেই বোঝাতে চেয়েছি, যার কয় চাকা ছোটবেলায় গোনার অনেক চেষ্টা করেছি। আহামরি কিছুই না, আবার অনেক কিছুও বটে। ছোটবেলা থেকেই একটা জিনিস খেয়াল করেছি যে মানুষের অনেক স্বপ্ন থাকে, সময়ের সাথে স্বপ্নেও পরিবর্তন আসে। কিছু জিনিস মানুষ অবেচতন মনেই নিজের করে পেতে চায়। পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব মেলানোর জন্য এখন লিখতে বসি নি। যখন স্কুলে ভর্তি হই তখন প্রায়ই মেইন রোড দিয়ে দোতলা বাস যেতে দেখতাম। বাস আরও যেত কিন্তু ঐ দোতলা বাসের দিকে তাকিয়ে থাকতাম বাসের নামের কারনে। বাসের নামটা আমার খুবই ভাল লাগত। বাসের গায়ে লেখা ‘বৈশাখী’ যখন পড়তে পারি, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখাটাও পড়তে পারাও উচিৎ। সেই সুত্রে জানতে পারি যে ‘বৈশাখী’ নামের এই বাসটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য। পরে জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে আমার মা-বাবাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাতায়াত করেছে, কিন্তু তাদের সময় এই রুটে কোন বাস চলত সঠিক জানি না। আম্মুর মুখে ‘চৈতালি’ নামটা বেশ কয়েকবার অবশ্য শুনেছি।
যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন বড় ভাই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তখন ফলাফল গিয়ে দেখতে হত। আমার মনে আছে, ঘুম থেকে উঠে শুনেছিলাম যে ভাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অনেক ভাল করেছে। পরে ভাইয়া ফার্মেসী অনুষদে এ ভর্তি হয়। এই সুবাদে ‘বৈশাখী’ নামের লাল বাসটা আমার আরও পরিচিত হয়ে যায়। হয়ত সে সময়টা থেকেই অবচেতন মনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিও একদিন পড়ব, এই বাসে করে যাব এমন একটা ইচ্ছা তৈরি হয়।অনেক সময় মাঝে পার হয়ে যায়, কিন্তু ঐ বাসের সাথে আমার নিত্য সাক্ষাৎ চলতেই থাকে। সময় আসে আমার ভর্তি হওয়ার। বললে অনেক কিছুই বলা যায়, সে আরেক গল্প কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তি হওয়ার সুযোগ হল না। কিভাবে ক, ঘ দুই ইউনিটেই ধরা খেলাম, কিভাবে হাতের মধ্যে আরাধ্য বস্তু পেয়ে হাতে রাখতে পারলাম না। সে অনেক কথা। কারও বা সময়ের দোষও আমি দিবনা। দোষ নিজের বলেই স্বীকার করি। তখন সেই দোতলা বাস যখন চোখের সামনে দিয়ে যেত বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। মনের ভেতরেও যে কেউ কাঁদতে পারে, সেই কান্না চোখের পানিতে প্রকাশ না পেলেও যে কাঁদা সম্ভব, তা নিজেকে দিয়েই বুঝতে পেরেছি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব হব এমন দোলাচলে ভুগতে থাকলাম। কিন্তু সংশয় শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চেষ্টা করায় উপনীত করল। অদ্রি, মাহবুব আর আমি একসাথে ভর্তি হলাম কোচিং এ। এক পর্যায়ে মাহবুব সাথে থাকতে পারল না, অদ্রি আর আমি একসাথে কোচিং করতে থাকলাম। এর মাঝেও বেশ কয়েকবার, বলতে গেলে মাঝেমধ্যেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য বাসায় জোরাজোরি করেছি। কিন্তু আশেপাশের মানুষদের তা বলতে পারি নি, কারন তাদের উৎসাহ নষ্ট করার ইচ্ছা ছিল না। এটা যদি নাবিয়া বা অদ্রি বা যারা কাছের ছিল এবং দ্বিতীয়বার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাদের মন ভাঙার জন্য যথেষ্ট ছিল। কোচিং থেকে বের হয়ে যখন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম তখন আবার এই লাল বাস চোখের সামনে দিয়ে যেতে দেখতাম মাঝেমধ্যেই। বুকের ভেতর একই সাথে হাহাকার এবং উৎসাহ কাজ করত। তখন আবার একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা। মাঝের এই সময়গুলোতে কাছের অনেক মানুষ ছিল। বিশেষ করে নাবিয়া আর অদ্রির কথা বলতেই হবে। ওদের সাথে অনেক অমূল্য স্মৃতি আছে ঐ সময়টার। অনেক ওঠা নামার মধ্যেও ঐ লাল বাস বারবারই উৎসাহের কারন হয়েছে।যেটুকু পরিশ্রম করেছি তার চেয়ে অনেক বেশিই ফল আল্লাহ দিয়েছেন। ক, ঘ দুই ইউনিটেই ভর্তির সুযোগ পাই। নিজের ইচ্ছা অনেক সময় কিছু মানুষের মুখের হাসির জন্য বিসর্জন দিতে খারাপ লাগে না। সে জন্যই হয়ত গণিত বিভাগের এখন ছাত্র আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখন নিয়মিতই যাতায়াত দূর থেকে দেখা ঐ লাল বাসে, বা সেই লাল বাসে যা কিনা ট্রিপ শেষে কিছু টাকার জন্য বাইরের যাত্রী নিচ্ছিল। তখন উঠতাম অচ্ছুতের মত (নিজের কাছে মনে হত)। এখন নিজের অধিকার নিয়েই উঠতে পারি (সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা)। সময়ের সাথে কিছু পরিবর্তন নিয়মিতই হয়; আজ যেভাবে ভাবছি কাল, সেভাবে তা নাও ভাবতে পারি।
প্রথমদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এই লাল বাসে যেদিন উঠি সেদিনের আত্মতৃপ্তি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এখন বাইরে থেকে তাকিয়ে দেখা লাগে না, সেই হাহাকারও কাজ করে না। সাথে অনেক কাছের মানুষ ছিল যারা উঠতে চেয়েছিল আমার মতই, কেউ কেউ আজ আমার সাথে উঠে, কেউ অন্য কোন গন্তব্যে। এটাও জানি এই লাল বাসগুলোতে এখন যারা আমার সাথে আছে, তারাও চিরজীবন আমার সাথে থাকবে না।
মানুষের মনে আশা বেঁচে থাকুক, বেঁচে থাকুক কিছু পাওয়ার তীব্র স্পৃহা, তার পিছে কাজ করুক কোন উৎসাহ। এই লাল বাসটা বাস্তবে শুধুই একটা বাহন, কিন্তু আমার কাছে আশা আর উৎসাহ হিসেবে কাজ করেছে। এখন হয়ত তা শুধুই বাহন। উৎসাহ ও আশাজাগানোর ক্ষমতাসহ এমন লাল বাস যেন সবার জীবনে থাকে, যেন কেউ অলস থাকার সুযোগ না পায়। স্বপ্নের পিছনে ব্যস্ততা একঘেয়ে না, প্রশান্তির এক রূপও বলা যায়।
বি.দ্র. লেখাটা আমার ফেসবুক প্রোফাইল এ নোট হিসাবে আছে। এখানে আমার বেশ কিছু বন্ধুর নাম এসেছে। যেহেতু বর্গমূল আমাদের কথা বলার এবং সবার সাথে শেয়ার করার জন্যই তাই কিছু কথা নিজের মত করে বলার চেষ্টা করলাম। ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ থাকল।
4 comments
Skip to comment form
এই সুন্দর লেখাটি আসলেই অস্থির হয়েছে। লেখাটিতে সব কটি বর্ণের সুষম বিন্যাস, দীপ্তিময় আলোকছটা, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং ধ্রুপদী সত্ত্বা সুন্দর অবয়বে এক অতিপ্রাকৃত আবহ সৃষ্টি করেছে। তাই লেখাটা দেখেই বিমলানন্দে লাইকালাম! ভাল্লাগছে বিষয়ডা। এরকম আবারও চাই …
Author
অনেক ধন্যবাদ 😀 😀
Onek manush ache jara nijeder jiboner choto choto asha valobasha, sukh-dukho-kosto onek sundor vabe tule dhore. Tumi tader e ekjon. Ekdin dekha hobe nischoy. Sedin hoyto tomar sopner bus thakbe na, kintu ke jane totodine hoyto poroborti projonmer mone eki khusi thakbe, tara tomar naam korbe. Bolbe “janis amar babao ei bus diye jawa asha korto, ki moja tai na?”
sei din tar opekkhay roilam 😉
Author
dekha hobe 🙂
khub valo laglo vaia 🙂 apnar comment pore