গল্পঃ ইচ্ছাপূরণ

If-You-Had-One-Wish-For-Marketing

চাকুরী একটা শেষ পর্যন্ত পেয়েই গেলাম । বিশাল অফিস । অনেক লোক একসাথে বসে কাজ করে । কি সুন্দর সাজানো গোছানো । ঢুকলেই মনে হয় অফিস না যেন সরাসরি বেহেশতে চলে এসেছি । তুমুল ব্যাপার হলো, একটা বড়লোক বস পেয়েছি । অনেক বড়লোক । কোটি কোটি টাকা । কানাঘুষায় শুনতে পাই ইনি নাকি সর্বশক্তিমান । যা চান তাই করতে পারেন । দেশের অর্থনীতি চলে ইনার টাকায় । রাজনীতি চলে ইনার টাকায় । ধর্ম-প্রেম-সমাজনীতি সব ইনিই চালান । তাই বস অফিসে ঢুকলেই তাকিয়ে থাকি । ঢুকেই হন হন করে হেটে চলে যান নিজের কামরায় । আহা কি চমৎকার লোক । দেশের সবাই চিনেন । আমার সাথে অবশ্য কোনদিন কথা হয়নি । তবে চোখাচোখি দুই-একবার হয়েছে নিশ্চয়ই ।

বেতন যা পাই ব্যাচেলর মানুষ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে পকেট খরচ চলে যায় ভালো ভাবেই । ভার্সিটি লাইফের কিছু অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারি নি । অফিসে প্রায়ই লেট করে আসি । তবে কোন সমস্যা হয় না । কেউ ডেকেও জিজ্ঞেস করে না । মাঝেমধ্যে চোখকটা করে একজনকে দেখি বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । লোকটি অফিসের আর কারো সাথে কথা বলে না । আমি পরিচিত হতে তার ডেস্কের সামনে গিয়েছিলাম । আমার দিকে একবার তাকিয়ে পিসিতে কি যেন টাইপ করতে লেগে গেলেন । পরে জেনেছি ইনি এরকমই । একমাত্র ইনিই প্রতিদিন বসের কামরায় যান ।

বিকাল হলেই রমনায় এষণার সাথে দেখা করতে যাই । বাদাম খেতে সন্ধ্যা পর্যন্ত গল্প করি । ইদানীং গল্পের টপিক একটাই । বিয়ে করতে হবে । আলাদা একটা ফ্ল্যাট নিতে হবে । কিছুদিন পর গাড়ী কিনতে হবে । এষণাই বলে । আমি শুনি । বাদাম খাই । বাদাম শেষ হলে আবার বাদাম কিনি ।

সন্ধ্যার পর পাড়ার মোড়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই । চা- সিগারেট ফুকি । আমিই এদের একমাত্র চাকুরীজীবী বন্ধু যে চাকুরী পাবার পরও রাত ১০ টা পর্যন্ত আড্ডা দেয় । ফেরার সময় অভি প্রতিদিনের মত জিজ্ঞেস করে ওর জন্য কিছু করতে পারলাম কিনা । অভির জন্য খারাপ লাগে । ন্যাংটাকাল থেকে একসাথে বড় হয়েছি । ছেলেটার বাবা মারা যাওয়ার পর তিন বোন-মা এর সংসার নিয়ে গভীর সমুদ্রের মধ্যেই পড়েছে ।

রাতে বাসায় ফিরেই হাত মুখ ধুয়ে সপরিবারে খেতে বসে যাই । এটা বাবার নিয়ম । সারাদিন যেখানেই থাকি । রাতে একসাথে খেতে হবেই । খাবার টেবিলে বড় ভাই , ভাবী এবং বাবা আমাকে পাত্তা দেন না । আমার সাথে কথাও বলেন না । নিজেরা নিজেরাই কথা বলে । আমি চুপ করে খেয়ে দেয়ে রুমে চলে যাই । মাঝে মধ্যে মা বা ছোটবোন রুমে আসে । জিজ্ঞেস করে এটা সেটা । এরপর পিসিতে বসে একটু নেট গুতাগুতি করি । কখনো ফোনে এষণার বস্তাপচা ফ্ল্যাট আর গাড়ীর স্বপ্নের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই ।
হঠাত করেই অফিসের কাজের চাপ বেড়ে গেল । অনেক কাজ । একটা বড় প্রজেক্ট। সকালে ঢুকে কাজ শুরু করি । সন্ধ্যায় বের হই । এষনার সাথে দেখা করার সময় পাই না । বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই না । রুমে শুয়ে বসে এমন কি খাবার টেবিলেও প্রজেক্ট নিয়ে চিন্তা করি । বড়লোক বসের কাজ । অনেক টাকার কাজ । করতে পারলে নিশ্চয়ই আমার প্রমোশন হবে । বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে পারব । অভিকে আমার অফিসে কোথাও ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করতে পারব । ফ্যামিলিতে ইম্পর্টেন্ট পারসন হতে পারব ।

কিছুদিন পর কাজের চাপ কমতে থাকে । বস একদিন আমাকে নিজের কামরায় ডেকে পাঠালেন । আমি শুনেতো অবাক । বসের কামরায় ঢুকব । বসের সাথে কথা বলব । এটা যেন স্বপ্ন ! ড্রয়ার থেকে আয়না বের করে টাই আর চুলের ভাজ ঠিক করে নিলাম । আশেপাশের সব কলিগকে জানালাম । বস ডেকেছে । বসের রুমে যাচ্ছি । শুনে সবাই হা করে তাকিয়ে রইল । সর্ব শক্তিমান বস । কলেভদ্রেই কেউ কেউ তার সাথে কথা বলতে পারে ।
– ম্যা আই কামিন স্যার !
বস চেয়ারে পেছন দিকে মুখ করে বসে ছিলেন । সামনে দিকে চেয়ার ঘোরালেন । মাথা নেড়ে ঈশারা করলেন ঢুকতে ।
– মিঃ ……… । বস সম্ভবত নাম ভুলে গেছেন ।
– মাই নেম ইজ প্রত্যয় স্যার ।
– সীট ডাউন প্লীজ ।

বসে টেবিলের উপরেই দেখলাম আমার করা কিছু কাজের ফাইল ।
– ওয়েল ডান মাই বয় । আই এম টোটালি সেটিস্ফাইড টু ইউর ওয়ার্ক । টেল মি হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ফ্রম মী । অ্যানি থিং ।
– ইয়েস সার ।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম । যে পরিশ্রম করেছি বিফলে যায়নি তাহলে ।
– বল বল । কি চাও আমার কাছে । যে কোন কিছু চাইতে পার ।
বুঝলাম না যে কোন কিছু কি চাওয়া যায় ।
– স্যার, যে কোন কিছু ? যে কোন ইচ্ছার কথা বলতে পারব ?
– হুম । যে কোন কিছু । তোমার একটা ইচ্ছা আমি পূরণ করব ।
আমি এবার একটা বোকার মত প্রশ্ন করে বসলাম ।
– স্যার, আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই ?
স্যার মৃদু হাসলেন । জবাব দিলেন ।
– চাইতে পার । যে কোন কিছু চাইতে পার । আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করব ।
চালাকি করে বললাম ,
– স্যার আমাকে একদিন সময় দিন । আমি কালকে ইচ্ছার কথা বলি ?
বস সায় দিলেন।

ভালোই করছি । এতবড় সুযোগ অল্প একটু সময়ের মধ্যে ছোট কিছু চেয়ে বসিনি । সবাই জানে বস সর্বশক্তিমান । তিনি চাইলে সব হতে পারে । আমি বসের কামরা থেকে বের হতেই অফিসের সব কলিগ আমাকে ঘিরে ধরল, বস কি বলল ।
সব শুনে তারা বলতে লাগল এবার প্রমোশনটা বাগিয়ে নিতে । আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম । এতবড় সুযোগ! প্রমোশনের মত মামুলি বিষয়ের কথা বলব ?

অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম । গাড়ীতে বসেই সিদ্ধান্ত নিলাম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছাটাই বসকে পূরণ করতে বলব ।
এষণাকে ফোন দিলাম । রমনায় না বসে ছোটখাট একটা ফাস্টফুডে বসলাম । মাসের সাতাশ তারিখ । পকেটে হাজার খানেক টাকার মত আছে । দুজনে ভালই খেতে পারব । বসের কথা বললাম । বসকে সবাই চেনে । সব শুনে এষণা তো দারুণ খুশী । আমাকে বলল,
– এই বুঝছ । প্রমোশন- টমোশন চাওয়ার দরকার নেই । তুমি বরং গাড়ীসহ সাজানো ফ্ল্যাট চাও । প্রমোশন তোমার এমনিতেই হবে ।
কথায় যুক্তি আছে । তবে শুধু গাড়ী-ফ্ল্যাট !
– এই শোন । এই সব আমি চাইতে পারব না । আমার ছোট বেলা থেকে শখ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার । আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাইব ।
– পাগলের মত কথা বল না ।
– আচ্ছা ।
বললাম তবে মনে মনে এষণার কথা পাত্তা দিলাম না । বিল আমার দিতে হল না । কয়দিন পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হব । ভাবতেই ভাল লাগছে । এষণার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় গেলাম ।
বন্ধুরা সব শুনে মহাখুশী । ফেরার সময় অভি চোখ ছলছল করে বলল,
– দোস্ত এবার আমার একটা চাকুরীর কথা বলিস ।

বাড়ীতে ডাইনিং টেবিলে ছোটবোন আমার দিকে তাকিয়ে বললঃ
– দাদা আজ খুব খুশী খুশী লাগছে যে তোমাকে ।
আমি বাবার দিকে তাকালাম ।
– বাবা ।
অনেকদিন পর বাবার সাথে কথা বললাম । বেকার হয়ে অনেক ঘোরাফেরা করেছিলাম । ভাইয়ার ব্যবসায় ঢুকতে বলেছিলেন বাবা । ঢুকেছিলাম । ঝগড়া করে আবার বের হয়েও এসেছিলাম । এরপর থেকেই বাবা- ভাইয়া ভাবীর সাথে কথা বলা বন্ধ । ভাইয়া -ভাবী -মা সবাই আমার দিকে তাকাল ।
বাবাকে অফিসের বসের কথা খুলে বললাম । বাবা আমার বস কে জিজ্ঞেস করলেন । বস যে সর্বশক্তিমান তা বাবা আগে থেকেই জানতেন । বুঝলাম বাবা খুব খুশী হয়েছেন । ভাইয়া মাকে বললেন মাংসের আরো কয়েক টুকরা আমার পাতে তুলে দিতে । ভাবী গ্লাসে পানি ঢেলে দিলেন । মা মাথার পাশে খবরের কাগজ দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন । সবাইকে বললাম আমি প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছি ।

রুমে ঢুকলাম । কিছুক্ষন পর ভাইয়া-ভাবী ঢুকল । বড় ভাই শুরু করল,
– শোন , এই সব প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পাগলামী চিন্তা বাদ দে । তোর বসকে বল একটা বড় আমাউন্ট লোনের ব্যবস্থা করে দিতে । আমি আর তুই দুইভাই মিলে ব্যবসাটা ভালোভাবে দাড়া করাই । তাহলে আর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না । ভাইয়া-ভাবী আরো অনেক কিছু বোঝালেন ।

ভাইয়ারা গেলে বাবা-মা ঢুকলেন । বাবা বললেন,
– শোনো প্রত্যয় । তোমরা বড় হয়ে গেছ । পরিবারের প্রতি তোমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে । তোমার ছোট বোনটারও অনেক বয়স হয়ে গেছে । তোমার বসের চেনা জানা অনেক ভালো অবস্থাসম্পন্ন ছেলে আছে । তোমার বোনের একটা ভালো বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে বল ।

বাবা-মা গেলে ছোটবোন ঢুকল । আমি চেয়ারে বসে পিসি অন করছিলাম । বোন পিছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল,
– দাদা । আমার একটা কথা রাখনা । তোমার বসকে বলে আমার জন্য আমেরিকায় একটা হায়ার স্টাডিজের ব্যবস্থা করে দাও না ।

আমি সবাইকে একটা কথাই বলে দিলাম । অপেক্ষা কর । হবে হবে সব হবে । আরে আমি প্রধান মন্ত্রী হলে তো সবার ইচ্ছাই পূরণ করতে পারব । রাতে এষনার সাথে কথা বললাম না বেশী । নেটে বসতেও ভালো লাগল না । জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম । আমি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছি । কত জনকে কত কিছু দিচ্ছি । এষণার ফ্ল্যাট – অভির চাকরি – ভাইয়ার লোন – বোনের হায়ার স্টাডিজের খরচ – একটা ভালো ছেলে দেখে বোনের বিয়ে । আরো কত কিছু । কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পাইনি ।

ঘুম থেকে উঠে দেখি ১০ টা বাজে । আরে অফিসের দেরী হয়ে গেছে । প্রধানমন্ত্রী হলে সব অফিস ১২ টায় করে দেব । সি এন জি নিয়ে অফিসের দিকে রওনা দিলাম । আজ আর দেরী সহ্য হচ্ছিল না । অফিসে ঢুকেই বসের কামরা বরাবর চলে গেলাম ।
– ম্যা আই কামিন স্যার ।
বস আজ সোজা বসে ছিলেন । একটা ফাইল পড়ছিলেন । বসের সামনের চেয়ারে চোখকটা করে লোকটা বসে ছিলেন ।
-ইয়েস কামিন ।
আমি ঢুকতেই চোখকটা লোকটা আমার দিকে বিরক্ত চোখে এক পলক তাকিয়ে কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন ।
– ইউ মিঃ ……?
– স্যার আমি প্রত্যয় । কাল আপনার সাথে দেখা করেছিলাম ।
স্যার আমার কথা কিছু শুনলেন বলে মনে হল না । ফাইলের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন ।
– ওহ । আপনিই প্রত্যয় ? আপনিই ডেইলী লেট করে অফিস আসেন ? ভাববেন না আমি অফিসের কোন খোঁজ রাখি না । এই দেখেন রিপোর্ট । এই কয়মাসে শুধু আপনিই অনেক অনিয়ম করেছেন । এভাবে তো অফিস চলবে না । ইউ আর ফায়ারড ।
আমি বুঝতে পারলাম না । আমার কি করা উচিত । বসকে বললামঃ
– স্যার কাল আপনি আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন ।
– ওহ । তাই নাকি ?
– জি স্যার । এবারকার মতো যদি স্যার আমার চাকরীটা রাখতেন খুব কৃতজ্ঞ থাকতাম ।

শেষ পর্যন্ত আমার সর্বশক্তিমান বস আমার ইচ্ছাপূরণ করেছিলেন । অভির একটা দারুণ চাকরী হয়েছে । ভাইয়ার ব্যবসাও খুব ভাল চলছে । ছোটবোনের বিয়ে হয়েছে এক আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সাথে । ইন্টারনেটে প্রেম করে । এষণার বাবা-মা ফ্ল্যাট-গাড়ী ওয়ালা ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে । আমারও টুকটাক প্রমোশন হয়েছে ।

চন্দ্রশেখর
Author: চন্দ্রশেখর

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/chondro/918/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

5 comments

Skip to comment form

  1. সুন্দর সুন্দর …

    1. 🙂 🙂

  2. ”এষণাই বলে । আমি শুনি । বাদাম খাই । বাদাম শেষ হলে আবার বাদাম কিনি ।”-মজা পাইলাম

  3. গল্পের মোরাল: নিজে বাচলে বাপের নাম

    1. ভালো মোরাল বের হইছে।

মন্তব্য করুন