গণিত সম্মেলনে এক বিকেল

গতকাল আর আজ আমাদের ভার্সিটিতে ছিল বার্ষিক গণিত সম্মেলন বা সিম্ফোজিয়াম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা এসে পেপার আর প্রজেক্ট প্রদর্শন করবেন। দেশে গণিত ফাঁকিবাজী করে পড়ে এসেছি। এখানে এসেও সরাসরি গণিতের একটা কোর্সও নেইনি ফার্স্ট সিমেস্টারে। আগ্রহ থাকলেও মনে হয়েছে কিছুই বুঝব না।

প্রচন্ড ঘুমে থাকায় আজ যেতে পারিনি। গিয়েছিলাম গতকাল। তিনটা থেকে লোক আসা শুরু হল। অগডেন অডিটোরিয়ামের সামনে বিভিন্ন রকমের খাওয়ার সাজানো। যার যা ইচ্ছে নিয়ে খাচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হল। অনেকে দাঁড়িয়েও রইল।

সাড়ে তিনটায় শুরু হল কীনোট টক। বক্তৃতা দিচ্ছেন জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা জেসন ক্যান্টারেলা। শিরোনামঃ ‘ক্যামনে সবসময় বীনব্যাগ টসে জিতবেন’ অথবা ‘কেন তুমি অল্প ক্যালকুলাস জান, এবং আরেকটু জানলে ক্যামনে তোমার জীবন পরিবর্তন হয়ে যাবে।’ ধরেন, আপনাকে একটা বল ফেলতে হবে, একটু দূরে, সামনে রাখা ঝুড়িতে। দুই একবার চেষ্টা করলে কিন্তু আপনি সহজেই ফেলতে পারবেন। কিন্তু কিভাবে আপনি এই বল ঝুড়িবন্দী করলেন? কিভাবে জানলেন যে, কোন গতিতে, কখন এবং কোন কোণে মারলে এটা ঝুড়িতে পরবে? জেসন, ছাই নামের একটা রোবট দিয়ে এই প্রশ্নের গাণিতিক ব্যাখ্যা এবং সিমুলেশন করে দেখাল। বিভিন্ন পজিশন রাখা  একটা ছোট কফির কাপের মধ্যে ছাই নির্ভুল ভাবে ছুড়ে মারল বল। মজা পেয়েছি দেখে। পুরো ভিডিও। 

জেসনের টক থেকে বের হয়ে হাতে থাকা স্কেজুলটা একটু দেখে নিলাম। একই সময়ে বিভিন্ন ক্লাস রুমে বিভিন্ন টপিক নিয়ে বক্তব্য চলছে। আমি গেলাম ট্রাফিক সিমুলেশন নিয়ে একটা প্রজেক্ট প্রদর্শন হচ্ছে সেই রুমে। সুন্দরী এবং মায়াবী চেহারার দুই এই ম্যাথমেটিকায় ট্রাফিক সিমুলেশনের কোড করে নিয়ে এসেছে। এখানকারই আন্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্ট। ম্যাথমেটিকা করেছি সেই কত বছর আগে। তখন এটাকে সিম্পল ক্যালকুলেটর ভেবে এড়িয়ে গেছি। ওদের কোডে একটা বাগ ছিল। যেমনঃ দুই একটা গাড়ী লাল বাত্তি দেখলেও থামে না। ওরা স্বীকার করে নিল এটা বাগ। অনেক চেষ্টা করেছে, কোথায় বাগ খুঁজে পায়নি। মন ভোলানো হাসি দিয়ে শেষে বলে দিল, বাস্তব জীবনেও তো এমন ঘটে। কেউ কেউ তো থাকে এরকম। লাল বাত্তি মানে না।

অন্যান্য রুমে তখন হচ্ছিল আরো মজার মজার <আসলে আমার জন্য মজার না, আমি বেশী কিছু বুঝি না> টপিক। যেমনঃ এলজেব্রিক প্রোপার্টিজ অব নিউরাল কোড, ডিসক্রিট লিনিয়ার টাইম স্পেস মডেল, মেথডোলজি এন্ড ডিমন্সট্রেশন অব ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম ইন্টারপ্রেটার, ভুংচুং। আমি বেছে বেছে রুবিক্স কিউবের এলগরিদমে গেলাম। এলগরিদম না জানলেও রুবিক্স কিউব কি বুঝি। আন্ডারগ্র্যাডের পোলাপাইন কত সামান্য সামান্য টপিক দিয়ে দেখানোর মতো গাণিতিক প্রজেক্ট করে এনেছে। গণিত পড়েও গণিতের প্রজেক্টগুলো এত সুন্দর এবং সবার জন্য বোধগম্য করা সম্ভব আগে ভাবিনি।

একটা ব্যাপার শেয়ার না করে পারছি না। গণিত সম্মেলন মানেই তো বোরিং হওয়ার কথা। এটা সারা দুনিয়ার জন্য সত্য। সাধারণ জনগণ মোটা দাগে গণিত ভয় পায়। গণিত বিরক্তিকর মনে করে। তারপরেও এত মানুষ কেন? ডিনার ছিল। খাওয়াদাওয়া ছিল। কিন্তু আমেরিকানরা তো খাওয়ার জন্য পুরো সম্মেলনে থেকে যাবে সেরকম তো না। মূল ব্যাপার হলো, আমার ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের ঘোষণা দিয়েছিলাম, যারা সম্মেলনে যাবে তাদের জন্য বোনাস মার্ক্স থাকবে। বিকালে যারা থাকবে তাদের দেওয়া হবে ৪ মার্ক্স। এবং পরদিন সকালের জন্য ৬ মার্ক্স। প্রমাণস্বরূপ দুইদিনের জন্য এক পৃষ্ঠা করে দুইটা রচনা লিখে আনতে হবে। প্রায় সব আন্ডারগ্র্যাড ক্লাসেই এই ঘোষণা গেছে। গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট হিসেবে আমার এরকম কোন বোনাস মার্ক্সের ব্যাপার ছিল না। তবে সম্মেলনের প্রতিটা কক্ষে গিয়ে দেখলাম, আন্ডারগ্র্যাড পোলাপাইন মহামনোযোগে খাতাকলম নিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের বিষয়বস্তু টুকে নিচ্ছে। প্রশ্ন করছে। উপভোগ করছে। কী সুন্দর! কী চমৎকার! কী অপূর্ব!   

সম্মেলনের ছবি দেখুন। 

চন্দ্রশেখর
Author: চন্দ্রশেখর

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/chondro/4688/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

2 comments

    • মোঃ মেহেদি হাসান হৃদয় on November 13, 2018 at 9:32 pm
    • Reply

    দাদ , আপনার এই লেখা পড়ে অনেক অনুপ্রাণিত হলাম। আসলে কি দাদা কোথায় যেন পড়েছিলাম যে, “If you are bad at physics that means you have taught by a bad teacher.” সম্ভবত এইটা ওদের ঐখানে খুব ই কম , আপনি ভালো জানবেন।

  1. একটা ভালো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারেন। এটা সত্য। তবে এখানকার সব শিক্ষক ভালো এমন না। তাই শিক্ষক যেমনই হোক, নিজের চেষ্টা থাকাটা জরুরী। এখন যেকোন কিছুই নেটে পাওয়া যায়। তাই চেষ্টা করতে হবে নিজেকে। আল্টিমেটলি শিক্ষককে দোষ দিলেও শেষবেলায় ক্ষতিটা হবে নিজের।

মন্তব্য করুন