গত ডিসেম্বর এ আমেরিকায় আমার একবছর পূর্তি হল। আমার কিছু অভিজ্ঞতা এখানে শেয়ার করব। ভাল লাগা খারাপ লাগা আমার দেখার বিষয় নয়। কে কি মনে করেন তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। আমি শুধু আমার দিকের ঘটনা গুলো বলার চেষ্টা করছি।
ঘটনা ১
আমি ইংলিশ বলতে পারি দেখে আমি এখানে আসার ১০-১৫ দিনের মধ্যে আমাকে Dunkin Donuts এর দোকানে কাজে ঢুকিয়ে দেয়া হল। জীবনে কোনদিন কাজ করতে হয় নি এরকম। সময়টা ছিল ২০১৩ এর জানুয়ারী মাস। ঝাড়া শীতকাল। এই শীতের মধ্যে আমার সকালে কাজ এর সিডিউল থাকায় ভোর ৫টায় উঠতাম, বরফ দিয়ে (জি হ্যাঁ) দাঁত মাজতাম, মুখ ধুতাম। তারপর ৫ মিনিট হেঁটে সাবওয়ে তে ট্রেন ধরতাম। সেটার শেষ স্টপে নেমে দৌড়ে বের হয়ে বাস নিতাম। যদি ট্রেন মিস করতাম, বা সাবওয়ে থেকে বের হতে দেরি করতাম, তাহলে বাস মিস হয়ে যেত। এখানে সবকিছু ঘড়ির কাঁটার সাথে চলে। ওখানে আমি প্রথমে ট্রেনিং নিচ্ছিলাম, কথা ছিল ট্রেনিং শেষ হলে পার্মানেন্ট জব হবে। চোখের সমস্যাটার কারনে ভয় পাচ্ছিলাম কাজ করতে পারব কি না, কিন্তু কদিন পরে মানিয়ে নিলাম। মনে হচ্ছিল কাজ পেয়ে যাব, কিন্তু দেখলাম, ট্রেনিং দেয়ার জন্যেও সিডিউল পাচ্ছিল না তারা। তারপরও করছিলাম, টাকার কষ্ট সবে শুরু হয়েছিল।
কদিন পরে সুপারভাইজার চুপি চুপি ম্যানেজারকে কি যেন বলল ফোন করে। সেদিন ম্যানেজার এসে আমাকে বলল
“আমি নিরুপায়, আপনার বাবা বলছিল আপনার চোখের সমস্যা আছে, কিন্তু এত সমস্যা আছে জানলে আমি আপনাকে নিতামই না, আপনি যতদিন আপনার চোখ ঠিক না করবেন, কোনদিন একটা ভাল চাকরি পাবেন না।”
আমি তাকে বলেছিলাম, “স্যার সেটা কোনদিনও হবে না, এটার ট্রিটমেন্ট নাই।”
“তাহলে আপনি কোনদিনও ভাল চাকরি পাবেন না।”
সেটা ছিল আমার জীবনের প্রথম রিজেকশন।
ঘটনা ২
ছয়মাস পরের ঘটনা। এরপরে আমার চাকরি (নাম মাত্র) হয় একটা গ্রোসারী দোকানে। মালিক ভাল হলেও যার দয়ায় আমি ঢুকেছিলাম সে মানুষটার সম্বন্ধে আর নাই বললাম। কিছু জিনিস তার মধ্যে ছিল (সারাজীবনই থাকবে) যাতে করে তাকে এ যুগের আইডিয়াল মানুষ বলা চলে না। তার শাসন মধ্যযুগীয় ইতালিয়ানদের মতন। তো যাই হোক, ট্রেনিং এর নামে আবার কাজে ঢুকলাম (যারা জানেন না তাদের বলে রাখি, এখানে ভাল দোকানগুলোতে ট্রেনিং এর সময়ও পে করা হয়, ছোটখাটো গ্রোসারীগুলোতে হয় না।) তার মধ্যে একদিন ছিল আমার জন্মদিন। তো অতিরিক্ত খাটাখাটির জন্যেই হোক, বা একমাত্র আলালের দুলালের জন্যেই হোক, মা বাবা আমাকে ১ দিন কাজে যেতে দিল না (জন্মদিনের পরের দিন। কারন ওইদিন সেলেব্রেসন করার পরে ঘুমাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।)
পরের দিন সেল ফোনে দেখি অনেকগুলো মিস কল। দোকানে গেলাম, এবং তার প্রথম কথা ছিল
“মানুষ এমন হয় জানতাম না, তোমরা সব পশুর দল।” [সে আমাকে এতদিন যা বলেছে সেটা আর শেয়ার করলাম না, অনেকের নানান রকম অপিনিওন থাকতে পারে আমার সম্পর্কে, মাফ করবেন। কিন্তু সে সেদিন আমার মা বাবাকে এবং তাদের দেয়া শিক্ষাকে গালি দিল। হয়ত আমার জীবনে এই অভিজ্ঞতারও দরকার ছিল।]
আমি এরপরে একদিন দোকানে যেয়ে মালিককে এই ব্যাপারে বলে আসি। বলে রাখা দরকার, সেই মানুষটার জ্যাঠামির জন্যে মালিক নিজেও তাকে দেখতে পারত না।
ঘটনা ৩
এরপরের ঘটনা আগের ঘটনার আরও ৩ মাস পরে [ঘর কিভাবে চলছিল নাই বললাম।]। আবার একটা Dunkin Donuts এ কাজ পেলাম। কাজ করেছি মাত্র ৩ দিন, এখানে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও হয়ত করতাম। আমার কলেজের কাগজপত্রের কিছু জটিলতা থাকায় রবিন কে বলেছিলাম টি এস সি থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফরম্যাট এর ত্রান্সক্রিপ্ট করে দিতে। ও করে দিয়েছিল। যেদিন কাগজ আসে সেদিন কাজে না যেয়ে কিউনির হেড অফিস এ দিয়ে আসি। যে কারনে এ চাকরিটাও যায়। [এম্নিতেও অনেক কষ্ট হচ্ছিল। মা বাবার আদরের সন্তান, কোনদিনই ওইরকম ভাবে সংসার চালানোর জন্যে কাজ করতে হয়নি। ওইদিন যদি না দিতাম, আজ পর্যন্ত আমার ভর্তি হওয়া আর হতো না। চাকরি আর একাডেমিক এক্সিলেন্স এর মধ্যে আমি একাডেমিক এক্সিলেন্সই বেছে নিলাম।]
ঘটনা ৪
২০১৩ এর সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আমার বাবার ভাগ্যে আমার এক টিউশনি জোটে। বাবা এই দেশে আসার পরেই একটা দোকানে বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছিল। সেটা কারও চোখে পরে ১ বছর পরে। তার ক্লাস সিক্স এর ছেলেকে পরাতে হবে। তিনি বাঙালি। কদিন গেলাম, বেতন দিয়ে ঝামেলা হল [যা হয় আর কি, ১৭০০ ডলার এর বাসা ভাড়া দিতে পারে, ২ ঘণ্টায় ৩০ ডলার দিতে আপত্তি। তাও আবার ২ সাবজেক্ট।] আমার বাবার ওষুধ আমি নেই দোকান থেকে, কারন তারা এখনও ভাল ইংলিশ বলতে পারে না [আমিও কিন্তু খুব ভাল পারি না।]। একদিন পড়ানোর সময় বারবার ফোন দিয়ে ওষুধের কথা বলছিল। সেদিন কোনোভাবে ম্যানেজ করলাম। প্রতিদিন জুতা টা বাইরে দাড়িয়ে পরতাম। ওরা দরজা বন্ধ করে দিত। আমি নিজে ইচ্ছা করেই এটা করতাম। সেদিন শুনতে পেলাম আমাকে বলছে, “আজেবাজে কথা বলে অর্ধেক সময় নষ্ট করে দিয়ে টাকাটা নিয়ে গেল।”, আমিও তো তাকে বলতে পারতাম, “আপনার ছেলেকে প্রতিদিন এক জিনিস পড়াচ্ছি, সব ভুলে যাচ্ছে। আমার বাবা মা তো কোনদিন আমার জন্যে শিক্ষক রাখেন নি, তাদের রাখার সামর্থ্য ছিল না।”। তার ছেলে নাকি আবার স্পেশাল ট্যালেন্ট সার্চ কাট্যাগরি তে পরে স্কুলে। আমি নিজে খুব ভালো পারতাম না, অনেক সংগ্রাম করে নিজেকে গড়েছি। সবসময় খেয়াল রেখেছি, আমি যেন একটা লিমিটে থাকি, যেন আমার জন্যে কোনদিনই টিচার রাখতে না হয়।
এরপরে কতদিন পড়ালাম। প্রতিদিনই ছাত্রের মা সামনে বসে আমাকে নির্দেশনা দিত কিভাবে পড়াতে হবে। অন্য সময় হলে ছেড়ে দিতাম, কিন্তু টাকার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছিল। আমি কোনদিনই লোভী না, অনেক সময়ই মানুষকে দিয়েছি [বিজ্ঞাপন দিচ্ছি না।], দিয়েছি নিঃস্বার্থ ভাবে। কিন্তু তখন আমি আমার মা বাবাকেও কিছু দিতে পারছিলাম না। ওই টিউশনিটার জন্যে অনেক কিছুই করতে পারছিলাম। কদিন পরে আমাকে বলল, “ছেলের স্কুল ছুটি হয়েছে, আপাতত লাগবে না, বোনের বাসায় যাচ্ছি, ফিরে এসে তোমাকে ফোন করব। পরের সেশন শুরু হওয়ার আগে তোমাকে দিয়ে কিছু পড়িয়ে রাখবো।” সেই যে আসলাম, আজ পর্যন্ত আমাকে ফোন দেয়নি। আমিও খচ্চরের মতন ফোন দেইনি। আমার ডিগ্নীটি বরাবরই একটু বেশি।
ঘটনা ৫
ইউনিভার্সিটি ভর্তি হলাম। একমাস পরে টিউটোরিং সেন্টারে অ্যাপ্লাই করলাম। পরীক্ষা দিলাম, সবকিছু ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই করলাম। বাসায় এসে কাপড় পালটাচ্ছি, মনে করেছিলাম কদিন পরে ফোন করবে, একটা ফোন পেলাম।
“হ্যালো, আমি টিউটোরিং সেন্টার থেকে ফোন করেছি।”
“জী বলুন।”
“আপনি পাশ করেছেন, দয়া করে [লক্ষ্য করুন] কালকে ইন্টারভিউ এর জন্যে আসতে পারবেন?”
“ঠিক আছে।”
গেলাম পরেরদিন। ইন্টারভিউ শুরু হলো।
“এখানে কেন আসলে? এই কলেজে? ফোর ইয়ার কলেজে কেন গেলে না?”
“স্যার আমার রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় আমাকে কোন কিউনি কলেজ নিতে চায় নি। বি এম সি সি কলেজ আমার মাত্র ২০ ক্রেডিট ট্র্যান্সফার করেছে। আমার এখন মাস্টার্স ডিগ্রি থাকার কথা।”
উনি বললেন, “অনেক শুনেছি রেজাল্ট দিয়ে জ্ঞান বিচার করা যায় না, আজকে আবার দেখলাম। তুমি জানো তুমি পাশ করেছ। এটা কি জানো তুমি কত পেয়েছ?”
ভয়ে ভয়ে বললাম, “না স্যার।”
“ইউ হ্যাভ স্কোরড ১০০%।” অন্য একজনকে বললেন, “দিস বয় রিয়েলি নোস হোয়াট হি ইস টকিং আবাউট, উই আর অনারড টু ওয়েলকাম ইউ অ্যামং আস”।
আমার হার্ট খুব স্ত্রং, সহজে কাঁদি না, সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এলাম [রাস্তায় বের হয়ে J], মনে হচ্ছিল ২০১০ এর ম্যাথেমা কন্টেস্ট এর কথা, সেদিনও এরকম হয়েছিল, কাউকে বুঝতে দেই নি। একটা জিনিসই মনে হচ্চিল, উপরওয়ালা হয়ত আমার রাস্তা করে দিলেন। যেমন কাঁদছিলাম, তেমন জরে হাসছিলাম, মনে হয় পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। এতগুলো রিজেকশন এর পরে বুঝলাম আমি পড়াতেই পারব। অন্য কাজ আমার দ্বারা হবে না। আমাকে তিনি এটাই বুঝিয়ে দিলেন। বাবা কে মেসেজ দিলাম, উত্তর আসলো, “আজ থেকে আমার আর কোন চিন্তা নেই, আমার ছেলে বড় হয়ে গেছে।” আবার কেন যেন কেঁদে দিলাম।
এতদিন অনেক গল্প লিখেছি। অনেকের ভালোবাসায় উতরে গিয়েছি। আজকে যা লিখলাম প্রতিটা বর্ণ সত্যি। ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে ভাল লাগবে। ধন্যবাদ।
1 comment
পারসুট অফ হ্যাপিনেস মুভিটায় ক্রিস (উইল স্মিথ) এর মতই জব কনফার্ম হওয়ার পর বোধ হয় ঐদিন কাঁদতে কাঁদতে হাসছিলেন। রেস্পেক্ট