ব্যস্ততার জন্য অনেকদিন লেখালেখি করা হয় না। আশ্চর্য লাগল এটা দেখে যে অনেকদিন ধরে কোন লেখাই পাই না এখানে। আজকে গনিতের গভীর দিকটা নিয়ে একটু বলব।
সারাজীবনই আমরা পড়ি। আসলেই যারা গনিতকে পছন্দ করি, তারা যে পরিমাণ পড়ি, সেটা মনে হয় মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের মতই। পড়ার চেয়ে বেশি মজা লাগে কিছু নিয়ে খেলতে। অনেকেই অনেক কিছু খেলেছি ছোটবেলায়। এবার একটু গনিত নিয়ে খেলার পালা। একটা কথা বলতে হয় এখানে। আমি নিজে খুব বেশি অঙ্ক পারি না। কিন্তু আমার ইচ্ছা অনেক বেশি। এতই বেশি যে কোন কিছু খুজে পেলে আমি অন্যদের বলি সেটা একটু ঘেটে দেখতে। সেটা যতই সামান্য হোক না কেন।
অবাক লাগে যখন সবাই বলে, “ভাইয়া, কিছু জিনিস নিয়ে খোজাখুজি করতে গেলে জানতে হয়। আমরা তো বেশি জানি না”, আরও অবাক লাগে যখন শুনি মানুষে বলে, “ভাই যেটা সবাই জানে, সেটা আবার বের করে আমি কি করব?”। সমস্যা হচ্ছে এরকম মন মানসিকতা নিয়ে কিচ্ছুই করা যাবে না। শুনতে যতই খারাপ লাগুক বলতেই হচ্চে, রামানুজন যখন জি এইচ হারডি কে চিঠি লিখেছিলেন তখন চিন্তা করেন কি কে কি বের করেছে আর কে কি করে নি। তিনি নিজের মনের আনন্দে চিঠিটা লিখেছিলেন। আমিও এরকম নিজের আনন্দেই অনেক উল্টাপাল্টা কাজ করে থাকি। রামানুজনের ইংরেজি অনেক খারাপ ছিল বলে তার বন্ধুরা সেটা থিক করে দিয়েছিল।
এখন আমি বলছি না আমি নিজেও রামানুজন। না, তার মতন চিন্তা শক্তি আমার কোনদিনও হবে না। কিন্তু ভগবানের ক্রিপায় আমি এমন অনেক বন্ধুবান্ধব ও শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ও দাদাদের পেয়েছি যারা নিজের কাজ ফেলে আমার উপকার করে দেন মাঝে মাঝেই। মানুষ অনেক আশা নিয়ে কাজ করে, কিন্তু ফলাফল না পেলে নিরাশ হয়ে যায়। অনেকে অনেক চিন্তা করতে করতে সারাজীবনে কোন চেস্টাই করে না। কিন্তু তাহলে কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলবে কই?
এবছর দেখতে দেখতে ভালই হাতেখড়ি হয়ে গেল। যা হতে চেয়েছিলাম, সেই পথেই চলা শুরু করেছি। সেটা বাস্তবায়ন হবে সেই চিন্তা আমার নেই, আমি শুধু চাই আমি আমার মনের আনন্দে কাজ করে যাব, যেভাবে এপর্যন্ত করে এসেছি। এ বছর বেশ কিছু জিনিস লিখে শেষ করেছি। বেশ কিছু সাফল্য এসেছে। সবচেয়ে তুচ্ছ জিনিসটা দিয়ে শুরু করছি। অন্যদের কাছে তুচ্ছ হলেও আমার কাছে এগুলোর মূল্য অনেক বেশি, কারন কিছু জিনিস যদিও আমরা অনেকে জানি (বই পড়ে মেনে নেই), তবুও নিজে করতে পারলে নিজের উপর আস্থা বাড়ে, যেটা আজকালকার মানুষের মধ্যে এক্সপোনেন্সিয়াল হারে কমে যাচ্ছে।
কয়েকদিন আগে বের করলাম, ডিভিশন মডুলো ১১। কিছুই না, ক্যাল্কুলেটর চাপতে চাপতে হঠাৎ একটা প্যাটার্ন পেয়ে গেলাম। কি যেন মনে হল, টাইপ করে ফেললাম। পরে অন্য ওয়েবসাইটে খোঁজ নিয়ে দেখলাম যা লিখেছি একেবারে অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। অনেকেরই কষ্ট লাগে তখন, কারন তারা দেখে তারা যেটা বের করেছে, সেটা সবাই জানে। আগেভাগেই করা হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কার কি আসে যায়। আমরা নিজেরা যে মজা করে জিনিসটা শিখলাম সেটা কেউ অনুধাবন করতে পারলো না? তাহলে আর আমাদের আর পাশ্চাত্তের দেশের মধ্যে তফাত হলো কোথায়? এতে অবশ্য আমি আমার দেশের ছোট ভাইবোনদের দোষ দেই না। তারা বড়ই হয়েছে এভাবে। স্কুলে ভাল না করলে ভাল কলেজ পাব না, কলেজে ভাল না করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে চান্স পাব না। ওখানে ভাল না করলে ভাল চাকরি হবে না। বিয়েটাও ভাল হবে না। কিন্তু কেউ কি কোনদিনও চিন্তা করে যে এর মধ্যেও অনেক মানুষ আছে যারা নিজের মনের জোরে মেধাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। মেধা নিয়ে কেউ জন্মায় না, নিজের চেষ্টায় এবং চারিপাশের পরিবেশের থেকে মানুষের মেধা বেড়ে ওঠে।
দ্বিতীয় কাজটার কথা বলি। আমার গত সেমিস্টারের অঙ্কের প্রফেসরটাকে আমি অনেক বিরক্ত করি। মাঝে মধ্যেই তাকে ইমেল করি। এজন্য তিনি মনে হয় একদিন বিরক্ত হয়েই হোক, বা আমার মাথা খারাপ করার জন্যেই হোক একটা অঙ্ক করতে দিলেন। ২ বার করলাম, এক্কেবারেই হয়নি। তৃতীয়বার করলাম, ১০০% ঠিক। আমার একটু খারাপ লাগল ঠিকই, যে একবারে পারলাম না। তবে এটাও তো ঠিকই বুঝলাম যে আমি আহাম্মক না, আমি চেস্টা করলে ঠিকই পারি। প্রফেসর যা লিখেছিলেন সেটা এখনও মনে আছে, “তোমার মতন নাছোরবান্দা পাবলিক তো দেখি না কোথাও। ওয়ে টু গো, অলয়েজ কিপ পুশিং ফর দা সল্যুশন”। এটা দেখে তো যে কারও কষ্ট চলে যাবে।
তৃতীয় কাজটা একটু বড়। আসলে আমি এরকম কাজই করতে চেয়েছিলাম। প্রফেসর সিমস এর তত্ত্বাবধানে লিখে ফেললাম একটা বিশাল বড় রিসার্চ পেপার। দ্যা ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক প্রপার্টিজ অফ প্রোটিন ইন দ্যা সেল মেমব্রেন চ্যানেল। কাজ শেষ হয়েছে, পেপার স্যার এর হাতে তুলে দিয়েছি। এখন শুধু অপেক্ষা প্রেজেন্টেশনের দিনের।
আগের কাজটা করার পরে আমার মাথা ভালমতন খুলে গেল। যারা আমাকে ভাল করে চেনে, তারা ভালই জানে আমি কেমন লিখি। কদিন আগে ইংরেজির প্রফেসর আমাকে বললেন, “তুমি এদেশের ছেলেমেয়েদের চেয়ে অনেক ভাল লেখ সেটা কি বুঝতে পার?”। অথচ গতবছর এক প্রফেসর আমাকে বলেছিলেন, “তোমার ইংরেজির এ অবস্থা কেন? তুমি আর যাই কর, সারাজীবনে ইংরেজি লিখতে পারবে না, তুমি নিশ্চয় তোমার দেশে রেজাল্ট খারাপ করে এসেছ (খারাপ বলেন নি) তাই এখানে কম্যুনিটি কলেজে ভর্তি হয়েছ (এটার কারনটা অনেকেরই জানা, তার এটা বলা উচিত ছিল না)”।
কদিন আগে ফিজিক্স এর একটা প্রজেক্ট করতে বললেন প্রফেসর ওয়াল্ডম্যান। করলাম, টপিক ছিল সেফ ডিস্ট্যান্স। খোঁজ নিয়ে দেখলাম এটা নিয়ে নিউ ইয়র্ক ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি বছরের পর বছর রিসার্চ করছে। উনি করতে বলেছিলেন প্রজেক্ট। করতে যেয়ে মজা পেয়ে গেলাম। লিখে ফেললাম আমার নিজস্ব রিসার্চ পেপার। প্রমান করলাম ৩ সেকেন্ড রুল এর একটা মজাদার দিক। নিজস্ব একটা রেজাল্টও বের করলাম। গ্রাফ প্লট করার পরে যখন দেখলাম লিনিয়ার রিগ্রেশন মডেল তৈরি হয়েছে, আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। ৭ দিন আগে এই পেপারটা জমা দিয়েছি। প্রফেসর বলেছিলেন, “তোমাকে তো আমি শুধু ফর্মুলা ডিরাইভ করতে বলেছি, এগুলা কেন করেছ?” বললাম, “স্যার, আমার মস্তিকের বিজ্ঞান ও গনিতকে সমৃদ্ধ করার জন্য করেছি। আমি যেখানেই যাব আমার দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরব। আমরা এভাবেই মানুষ হয়েছি স্যার, অপরাধ হলে ক্ষমা করবেন”। আমি এখনও পেপারটা ফেরত পাই নি। তবে এটুকু বলতে পারি। স্যার যদি আমাকে নাম্বার না দেন, আমি এতটুকু অখুশি হব না কারন আমি জানি আমি কি শিখতে পেরেছি।
শেষ গল্পটা এরকম মজাদার না মনে হলেও, আমার জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। আমার যেহেতু ইংরেজিতে সমস্যা তাই যেকোনো পেপার লিখলে এক বড় ভাই কে দিয়ে চেক করাই (নাম বলব না, আমি জানি উনি এটা কোন সময় পড়বেন, তার মুখের হাসিটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম)। প্রথমে ২ বার লিখলাম। উনি বললেন হয়নি। পরে আস্তে আস্তে ঠিক করতে করতে তৃতীয়বার গিয়ে মনে হল একটা জুতসই পেপার লেখা হয়েছে। যেয়ে জমা দিলাম। এরপরে যা ঘটল সেটা অপ্রত্যাশিত। প্রফেসর বললেন “আমার এক ছাত্রী এখন বিএমসিসির পাবলিকেশন এর দায়িত্বে আছে। তোমরা কেউ যদি কিছু লিখতে চাও ওর সাথে যোগাযোগ করে আমার নাম বললেই হবে। লেখা ভাল হলেই ও নিয়ে নিবে”। এটা তো কিছুই না। সবচেয়ে অবাক হলাম ক্লাশ শেষে আমাকে ডেকে বললেন, “তুমি তো ভাল লেখ, তুমি পরের বছর ফল সেমিস্টারে ট্র্যান্সফার নেবে জানি, আমি তোমাকে রিকমেন্ডেশন লেটার লিখে দিব। কিন্তু এখান থেকে যাওয়ার আগে এখানে একটা দাগ রেখে যেও, আমি তোমাকে রিকমেন্ড করেছি বিএমসিসি পাবলিকেশন এর অফিসে”। আমার কয়েক সেকেন্ড কথা বন্ধ হয়ে গেল। সেটা নিয়েই লিখব ভাবছিলাম। মনে হল বর্গমূলে সবার সাথেই খুশিটা ভাগাভাগি করি।
আমার এগুলো পড়ে মনে হতে পারে আমি নারসিসিস্টিক। হোক না, তবুও কেউ যদি আমার কথা গুলো বুঝতে পারে তবে ভাল লাগবে। সামনে এগোও, কেউ তোমাকে ধরে রাখে নি, সবই মনকে সামলানোর উপর নির্ভর করে।
2 comments
তোমার সাফল্যের খবর পড়ে ভালো লাগল। থেমে থেকো না, চালিয়ে যাও। আরেকটা কথা, তুমি narcissist না।
Author
একটু আপডেট দিব। যে ফিজিক্স প্রজেক্টটা জমা দিয়েছিলাম, সেটা ফেরত পেয়েছি। অনেকেই দেখেছে, যারা জানে না তাদের বলি, ১০০ তে ১০৫ দিয়েছেন প্রফেসর। যখন নিতে গেলাম, হাত পা ছোড়ার মতন একটা ভঙ্গি করে বললেন, “যা বাবা, তোর নাম্বার নিয়ে যা”। 😀