গাণিতিক তত্ত্বের স্বয়ংক্রিয় প্রমাণ

শিরোনামটা সহজ ভাষায় একটু ব্যাখ্যা করি । গণিতবিদরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, দিনের পর দিন সাধনা করে একটা তত্ত্ব প্রমাণ করেন । কিন্তু এমন যদি হয় যেকোন তত্ত্ব প্রমাণ করা বা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণগুলো ঠিক আছে কিনা তা ঘেটে দেখার জন্য কোন কম্পিউটার সিস্টেম হাজির করা হল, তবে কি হবে ? এটা কি আসলেই সম্ভব । এই  ছোট্ট লেখার বিষয়বস্তু এটাই এবং শিরোনামটাও তাই নির্দেশ করে।

প্রথমেই বলে রাখি লেখাটা আমি লিখছি কয়েকদিন আগে হয়ে যাওয়া একটা কনফারেন্স এর উপর ভিত্তি করে । কনফারেন্সটা সম্পর্কে জানা যাবে এখানে

১ ঘণ্টা ৩৯ মিনিটের পুরো কনফারেন্স দেখা যাবে এখানে –

যারা আগ্রহী তারা অবসর সময়ে হালকা মুডে কনফারেন্সটা দেখে নিতে পারেন । গণিত নিয়ে কনফারেন্স মনে করে কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু পুরোটা সময় উপভোগ্য এবং সবার জন্য বোধগম্য আলোচনাই হয়েছে । মানুষ হিসেবে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি , বা চারদিকে যে এত “অটোমেশন”, “অটোমেশন” বলে চিৎকার শুনছি, সেই অটোমেশন কি গণিতবিদদের মাঝেও আসবে ?

বক্তারা অনেক কথাই এখানে বলে গেছেন । আমি শুধু এখানে সারাংশ তুলে ধরব ।

ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব যে মানুষ যতবার তার সময় বাঁচানোর জন্য প্রযুক্তির সাহায্য নিতে গিয়েছে ততবারই বরং প্রযুক্তি শেখা আর রক্ষণাবেক্ষণে বেশি সময় দিতে হয়েছে । গণিতের ক্ষেত্রেতো হাতে বা পেন্সিল-পেপারে সমস্যা সমাধানের চেয়ে ভালো কোন পদ্ধতি নেই । তারপরও যখন মেশিনের সাহায্য নেওয়ার প্রশ্ন আসছেই, আমাদেরকে বুঝতে হবে যে আমরা আসলে কী চাই ? নতুন কোন থিওরী/তত্ত্ব এর জন্ম দিতে চাই নাকি বর্তমান তত্ত্বগুলোরই আরও ভালো প্রমাণ চাই । আমরা যদি মেশিনকে ভালোভাবে বুঝতে পারি তবে তা থেকে আমরা ভালো কোন কিছু আবিষ্কারও করে ফেলতে পারি ।

শার্লক হোমসকে তো আমরা সবাই চিনি । সে সমস্যা সমাধানের জন্য নিজের মাঝে একটা আলাদা পৃথিবী তৈরি করেছে । সেখানে আলাদা ঘর আছে, পানির গ্লাস আছে । প্রতিটা জিনিস তাকে কিছু না কিছু মনে রাখতে সাহায্য করে । গণিতবিদরাও তাদের মনের মাঝে আলাদা জগত তৈরি করে । মেশিনকে যদি এভাবে নিজেদের মাঝে আলাদা জগত তৈরি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়, তবেই না তারা গণিতবিদদের সমকক্ষ হবে ! AI বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুইটা ধরন আছে – ANI (Artificial Narrow Intelligence) এবং AGI (Artificial General Intelligence) । ANI এর ব্যাপারটা অনেকটা অটোমেশনের মতই, আর AGI হচ্ছে আমরা টার্মিনেটর মুভিতে যা দেখি তা, একেবারে মানুষের মত ভাবতে পারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা । AGI এ পৌছান আদৌ কখনও সম্ভব হবে কিনা কে জানে! অন্তত বিশেষজ্ঞদের মতে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আগামী কয়েকশত বছরে নেই । তাই একেবারে গণিতবিদদের মত ভাবতে পারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দেখা সহসাই আমরা পাচ্ছি না ।

এর বাইরে একটা সমস্যা হচ্ছে, আমরা সফটওয়ার বলি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলি, যেকোন প্যাকেজ কিংবা যন্ত্র খুব দ্রুত সেকেল হয়ে যায়। বাস্তবে দেখা যায়, একই সফটওয়ারের কয়েকটা ভার্সন একই মাসে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে । এব্যাপারে একটা মজার উদাহরণ দেওয়া যায়, ইউক্লিডের প্রমাণ যেখানে প্রায় ৩০০ বছর ধরে গ্রহণযোগ্য ছিল, সেখানে এখন পর্যন্ত ৫০ বছর টেকা সফটওয়ার পাওয়াই মুশকিল । তারপরও আমরা এ নিয়ে ভাবতেই পারি, কারণ গণিতবিদদের মাঝেই দক্ষ অনেকের বয়স হয়ে যাচ্ছে । এমনও হতে পারে, আর বেশ কিছুদিন পরেই হয়ত কোন বিশেষায়িত শাখায় পড়ানোর মত আর চিন্তা করার মত মানুষ খুঁজে পাওয়াই কঠিন হবে ।

একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার যখন প্রথমবার কোন কোড লিখে তখন তাতে গড়পড়তা প্রতি লাইনে ১.৫ পরিমাণ ভুল থাকে । এটা সাধারণ হিসেব । এমনকি সাধারণের জন্য ব্যবহার উন্মুক্ত করে দেওয়া সফটওয়ারেও প্রতি ১০০ লাইনে ১ টা ভুল থাকে । অন্যদিকে, বলা হয়, গণিতের একটা পেপারে প্রতি পাতায় অন্তত একটা ভুল থাকে । অটোমেশনের কথা ভাবতে গেলে আমাদেরকে ভুলের ব্যাপারগুলো মাথায় রাখা লাগবেই ।

এখন বা অনেকদিন ধরে একটা জনপ্রিয় ধারণা চালু আছে, মানুষ আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মিলে “সুপার হিউম্যান” এর জন্ম দেওয়া । এভাবে ভাবলে ব্যাপারটা পুরোই উল্টে যায় । কিন্তু ঐ যে বললাম, এ ধরনের কিছু বাস্তবে আসা থেকে আমরা অনেক দুরে আছি । মেশিন শুধু তাকে দেওয়া ডাটা এর মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, সেটার ফলাফল কী খারাপ না ভালো তা বুঝার মত জ্ঞান তো তার নেই !  তাছাড়া গণিতের অটোমেশনে মানুষ কেনই বা টাকা ঢালবে ? গণিত থেকে তো সরাসরি অর্থ উপার্জন করা যায় না ।

উইলিয়াম বুরও (William Burroughs) নামের এক ভদ্রলোক বলে গেছেন, “একজন খারাপ বিক্রেতা কখনও মানুষের কাছে তার প্রোডাক্ট বিক্রী করেন না, বরং মানুষকে তার প্রোডাক্টের কাছে বিক্রী করেন। সে কখনও তার প্রোডাক্টের উন্নতি করে না, বরঞ্চ সে তার ক্লায়েন্টদের অভ্যাস বা মানবিক গুণগুলোকে নিচে নামিয়ে আনে !” গণিতের অটোমেশন করতে গেলে এমন কিছু হবে না তো !

মেশিন লার্ণিং কিংবা এধরনের প্রযুক্তিগুলো এখনও শিশু পর্যায়ে থাকার আরেকটা উদাহরণ -এলগরিদম ঠিক করে না দিলে বা ভালো ডাটা না দিলে একটা মেশিন তো দুই আর দুই যোগই করতে পারবে না । তারপরও মানুষ অটোমেশন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে বা যাবে ! অন্তত গাণিতিক তত্ত্বের প্রমাণগুলো যদি মেশিন চেক করে ভুল আছে কিনা তা ধরিয়ে দিতে পারে তবে ভালোই হয় !  গণিতবিদদের বিনিদ্র রাত, এলোমেলো নোটবুক এসবকে যদি গুরুত্ব না দেই, তবে শুধু সবশেষে বের হওয়া তত্ত্বের প্রমাণের কথা ভাবলে লাভ হবে না। একটা গাণিতিক তত্ত্ব প্রায় সময় একাধিকবার প্রমাণ হয়েছে শুধু এটা বুঝার জন্য যে একটা নির্দিষ্ট প্রমাণ কেন কাজ করছে, যেখানে অন্যগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না । একটা প্রমাণের করোলারী বা অনুসিদ্ধান্ত থাকে, মেশিনকে আমরা সেখানে কাজে লাগাতে পারি । এবং অবশ্যই শুধু বিশুদ্ধ গণিত নয়, মেশিনকে গণিতের প্রায়োগিক দিকগুলো সম্পর্কেও শিক্ষা দিতে হবে, নাহলে তারা আমাদেরকে বাস্তব সম্মত সেবা দিতে পারবে না ।

 

Md. Noor Faizur Reza
Author: Md. Noor Faizur Reza

আমার যে কাজ ভালো লাগে তা নিয়ে সারাদিন পরে থাকি !

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/rezanur/4844/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

মন্তব্য করুন