কার্যকর শিক্ষকতার বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ

“ব্যাসিক টিচিং ইফেক্টিভনেস” নামের একটা ছয় সপ্তাহের কোর্স সম্পন্ন করলাম। কোর্সের শেষে কি শিখেছি তা গুছিয়ে ফাইনাল একটা পোর্টফোলিও জমা দিতে হয়। পোর্টফোলিও লেখা শেষ করলাম। ভাবলাম বাংলায় এটা নিয়ে কিছু লিখে ফেলি।

Course Syllabus:
যেকোন কোর্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সিলেবাস। যেকোন কোর্সের শুরু করার আগেই এখানে শিক্ষার্থীরা ওই কোর্সের সিলেবাস দেখে নিতে পারে। সিলেবাসের প্রথমেই ওই কোর্সের লার্নিং অবজেক্টিভ লিখে দেওয়া। কোর্সের Prerequisite উল্লেখ থাকে।  কি পড়ানো পড়ানো সেই বিষয়গুলোর একটি তালিকা থাকে। পরীক্ষা কবে কবে হবে এবং কিভাবে হবে সেটার একটা ধারণা থাকে। গ্রেডিং এর ধরণ কিভাবে হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত থাকে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের আচরণ কেমন হবে যেমনঃ মোবাইল বা টেকনোলোজি ব্যবহার করতে পারবে কিনা বা অনুপস্থিত থাকতে পারবে কিনা বা এসাইনমেন্টের কাজ কতটা শেয়ার করা যাবে, ইত্যাদি থাকে। এবং শিক্ষকের সাথে যোগাযোগের জন্য ইমেইল/ফোন নং দেওয়া থাকে ও তার অফিস আওয়ার উল্লেখ থাকে। অফিস আওয়ারে শিক্ষার্থীরা আগে থেকে ফোন বা ইমেইলে যোগাযোগ না করেও সরাসরি অফিসে যেয়ে শিক্ষকের সাথে কথা বলতে পারে।

Learning Objective:
লার্নিং অবজেক্টিভ যা বাংলায় শিখন ফল, সিলেবাস তথা পুরো কোর্সের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।  লার্নিং অবজেক্টিভ হলো কোর্সটা করার পর শিক্ষার্থীরা কি আয়ত্ত্ব করতে পারবে। একজন শিক্ষক ক্লাস নেওয়া শুরু করার আগে যদি এই জিনিস ফিক্সড না করেন, তাহলে অনেক বিপদ। যদিও বাংলাদেশে এই জিনিসের ছিটেফোঁটাও দেখিনি কোন দিন। এমনকি আমেরিকান কিছু বুড়া টিচার এইগুলারে পাত্তা দেয় না। কিন্তু এই জিনিস থাকলে আর শিক্ষার্থীরা এটা হাতে পেলে পুরো কোর্স অনেক সহজ হয়ে যায়।

পুরো কোর্সের কয়েকটা লার্নিং অবজেক্টিভ থাকে। আবার কোর্সের প্রত্যেকটা অধ্যায় ভিত্তিক কয়েকটা করে লার্নিং অবজেক্টিভ থাকতে পারে। ধরা যাক, কোর্সের একটা লার্নিং অবজেক্টিভ হল “Realize the significance of ethical behavior in the business environment”। এটা কি কোন ভালো অবজেক্টিভ? লেখা আছে রিয়ালাইজ। কোর্সের শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা রিয়ালাইজ করছে করছে কিনা তা কিন্তু পরিমাপ করা যায় না। এটা একটা অস্পষ্ট লার্নিং অবজেক্টিভ। এরকম আরেকটা বাজে লার্নিং অবজেক্টিভ হলোঃ “Understand the basic concept of limit”. Understanding বা Realization কিন্তু পরিমাপ করা যায় না। এইটাইপ ভার্ব গুলোকে বলে নন একশন ভার্ব। আরো নন-একশন ভার্ব আছে। যেমনঃ Know, Recognize, Comprehend, ইত্যাদি।  ভালো লার্নিং অবজেক্টিভ লেখার একটা SMART উপায় আছে। এটা হলো Specific, Measurable, Achievable, Realistic and Timed. শব্দগুলো পড়েই বোঝা যাচ্ছে এগুলো কেমন হবে। তাই বিস্তারিত লিখছি না। তবে Specific ও Measurable করার জন্য কতগুলো একশন ভার্ব আছে, যেগুলো অবজেক্টিভে ব্যবহার করা যেতে পারে। একশন ভার্বঃ Compute, Calculate, Demonstrate, Solve,ইত্যাদি। একশন ভার্বের কতগুলো প্রকার আছে। সাধারণত অনার্স লেভেলের শিক্ষার্থীর জন্য চার্টের প্রথম তিনটা ব্যবহার করা হয়।

Instructional Alignment:
যদি এখানে দেওয়া চার্ট মেনে অবজেক্টিভ তৈরি করা হয়, তাহলে কিন্তু ক্লাস নেওয়া, এসাইনমেন্ট বা বিভিন্ন ক্লাস এক্টিভিটি দেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া, ইত্যাদি অনেক সহজ হয়ে যায়। এই বিষয়গুলো ঠিক করাকে বলা হয় Instructional Alignment । কোর্স অবজেক্টিভ সঠিক ভাবে লিখে সেই অনুসারে ইন্সট্রাকশনলা এলাইনমেন্ট ঠিক করলে শিক্ষার্থীদের অনেক উপকার হয়। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার দরকার। Course Objective কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে উন্মুক্ত থাকে। তাই শিক্ষক ভালো পড়াতে বা বোঝাতে না পারলে বা শিক্ষার্থীরা নিজেরা বুঝতে না পারলেও এটা বোঝে যে পরীক্ষায় কি কি আসবে এবং কোর্স শেষ তার কি কি জানতে হবে। আর ইন্সট্রাকশনাল এলাইনমেন্ট কিন্তু শিক্ষক নিজের জন্য ঠিক করবেন। কিভাবে তিনি শিক্ষার্থীরা লার্নিং অবজেক্টিভ আয়ত্ত্ব করতে সাহায্য করবেন সেগুলোই এটা।

First Day at Class:
শিক্ষক হিসেবে ক্লাসের প্রথম দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা এই দিনেই কোর্স আর শিক্ষক সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে যায়। সিলেবাস সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সিলেবাস রিডিং পড়া খুবই বিরক্ত কর। তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছে কি আউটপুট আশা করছেন, ক্লাসের ধরণ কেমন হবে, এইসব নিয়ে কথা বলতে পারেন। প্রথমদিনেই পুরোদমে পড়ানো শুরু করার চেয়ে কোর্সের এবং সামনের ক্লাসগুলোর আউটলাইন দেওয়াটা জরুরী।

Classroom Management Issues:
ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। ক্লাস অনেক সময় অনেক ছাত্র থাকে। ক্লাসে দুষ্ট, অমনোযোগী, ইত্যাদি স্টুডেন্ট থাকে। এই জিনিসগুলো হ্যান্ডেল করা খুব কঠিন। ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট ইস্যু তাই বড়ব্যাপার। গুগলে সার্চ দিলে এইগুলো নিয়ে আর্টিকেল পাওয়া যাবে।
নিচের লিস্টের কোন একটা করলে এগুলোকে বলায় Challenge to Authority:

  • Talking
  • Cell phone rings
  • Tardiness
  • Reading newspaper
  • Sleeping
  • Leaving
  • Backtalk
  • Texting

সাধারণত শিক্ষকেরা এইগুলো দেখলে রেগে যান। তবে এই বিষয়গুলো হ্যান্ডেল করার জন্য সুন্দর একটা টেকনিক আছে। WAIL,। • W – wait • A – assess • I – individualize • L – lighten the mood (if possible) এইগুলো নিয়ে লিখতে গেলে পাতার উপর পাতা লেখা যাবে। তবে মূল বিষয় হলো রাগ করা যাবে না। হেসে হেসে করা সমাধান সবচেয়ে ভালো।

Micro-Activity:
মাইক্রো-এক্টিভিটি হলো ক্লাসের মাঝের বোরিং অবস্থা কাটাতে নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম। সাধারণত একজন মানুষ ১৫-২০ মিনিটের মতো মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। তাই পুরো ক্লাসকে কয়েকভাগে ভাগ করে মাঝে মাঝে মাইক্রো-এক্টিভিটি করালে পুরো ক্লাসের মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব। ধরা যাক ১৫ মিনিটে কিছু শেখানো হয়েছে। গবেষণা বলে, এই ১৫ মিনিটের প্রথম ৫ মিনিট এবং শেষ ৫ মিনিটের বিষয় ছাত্রছাত্রীরা ভালোই বুঝতে পারে। মাঝখানের ৫ মিনিট ভুলে যাওয়ার সম্ভবনা বেশী। তাই ওই ৫ মিনিট নিয়ে মাইক্রো-এক্টিভিটি করানো যেতে পারে। অনেক ধরণের মাইক্রো এক্টিভিটি আছে। বিষয় অনুযায়ী শিক্ষক নিজেই ২-৫ মিনিটের মাইক্রো এক্টিভিটি তৈরি করতে পারেন।  আমি একটা লিস্ট শেয়ার করলাম। আর একটা উদাহরন দেই যেটা আমি ক্লাসে মাঝে মধ্যে করি। একটা বল ছুড়ে দেই ক্লাসের যেকোন একজনের উদ্যেশ্যে। তারপর বলি একটা প্রশ্ন করো তোমার পাশের জনকে। পাশের জনকে সেটার উত্তর দিতে হয়। তারপর সে সেই বল আরেকজনকে ছুড়ে মারে। মজা হয় ভালোই। তবে আমি এই ধরণের একটার বেশী মাইক্রো-এক্টিভিটি করি না। আরেকটা একটিভিটি করি। সেটা হলো পুরো ক্লাসে যা পড়ালাম তার উপর ৫ মিনিটের একটা কুইজ নেই। আগে থেকেই প্রশ্ন প্রিন্ট করে আনি। সাধারণত ক্লাসের মাঝখানের কোন টপিকে একটা অংক করতে দেই। এই মার্ক ছাত্রছাত্রীদের মূলগ্রেডে যোগ হয়। টিচিং এসিস্টেন্ট হওয়ায় আমার স্বাধীনতা খুব একটা বেশী না। তবে আমি কখনো পুরো ক্লাস নিলে মাইক্রো-এক্টিভিটিতে আরো মার্ক্স যোগ করতাম।  

Assesment:
এসেসমেন্ট হলো পরীক্ষার প্রশন, প্রজেক্ট বা এসাইনমেন্ট তৈরি করা। এগুলো শুধু শুধু তৈরি করলেই হবে। প্রত্যেকটা এসেসমেন্ট তৈরি করার আগে লার্নিং অবজেক্টিভ অনুসরন করতে হবে। ক্যালকুলাস-১ এর জন্য আমার তৈরি করা একটা এসেসমেন্ট শেয়ার করছি। শিক্ষার্থীদের জন্য একটা প্রজেক্ট। এর সাথে আমি কিভাবে ওই প্রজেক্ট গ্রেডিং করব সেটাও দেওয়া আছে। এগুলো কিভাবে তৈরি করা যায় সেটা নিয়েও অনেক কথা বলতে হবে। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস শেয়ার করছি। এসেসমেন্ট কিন্তু তৈরি করা হচ্ছে স্টুডেন্টরা কতখানি লার্নিং অবজেক্টিভ আয়ত্ব করতে পারছে সেটা বোঝার জন্য। তাই এই বিষয়গুলোতে কিকরম কি আসতে পারে তা শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট করা বলা। অনেকটা সাজেশন দেওয়ার মতো। প্রত্যেকটা এসেসমেন্টের মার্কিং সম্পর্কে ধারণা দেওয়াও আবশ্যক। যাই করেন না কেন, সবসময় লার্নিং অবজেক্টিভ সার্ভ করতেছে কিনা এইসব, খেয়াল রাখতে হবে।

পুরো ছয় সপ্তাহের জিনিস ছোট্ট একটা লেখায় প্রকাশ করা যায় না। উল্লেখযোগ্য অংশগুলো করলাম। দিন বদলাইছে। একজন টিচারের শুধু পড়াইতে জানলেই হবে না। লার্নিং থিওরীও জানা দরকার। পোলাপান কেমনে কম্প্রিহেন্ড করে সেটা জানা দরকার।  অনেকের টিচিং কোয়ালিটি ভালো না। কিন্তু সে যদি একটু চেষ্টা করে সবকিছু গুছায়ে ফেলে, তাহলে শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক লাভজনক। আরেকটা কোর্স শুরু করেছি। “কোর্স ডিজাইনিং”। ওইটা নিয়ে লেখার চেষ্টা করব। যদিও আমার শিক্ষক হবার ইচ্ছা কম। কিন্তু এগুলো জানতে ভালো লাগতেছে। বাংলাদেশে অন্তত ভার্সিটি শিক্ষকদের এই ধরণের কোর্সগুলো করানো হলে শিক্ষার্থীদের উপকার হত।

সহায়ক উপাদান ডাউনলোড

চন্দ্রশেখর
Author: চন্দ্রশেখর

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/chondro/4823/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

3 comments

  1. ক্লাসের দুষ্টু পুলাপান হ্যান্ডেল করেন ক্যাম্নে? :3 বদের হাড্ডির তো অভাব থাকার কথা না 😛

    1. পোলাপান দুষ্টামি হ্যান্ডেল করা নিয়ে একটা ক্লাস ছিল। এইরকম একটা হ্যান্ড আউট দেখ

  2. কাজে লাগবে লিখাটা 😀

মন্তব্য করুন