হাবলুর ঢাকা দর্শন

বাহ !! শেষমেষ কাচপুর ব্রীজখানা দর্শনে আসিলো। হাবলু বাসের জানালা দিয়া আকুল নয়নে চাহিয়া থাকে। আর কিছুক্ষণ পরেই তাহাদিগের বাসখানা ঢাকাতে প্রবেশ করিবে। কত কাহিনী শুনিয়াছে সে ঢাকাকে নিয়া। এইখানে নাকি বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খায় !! তাহার গ্রামের এক বড় ভাইতো তাহাকে বলিয়াই দিয়াছে, “ওহে !! হাবলু !! ঢাকা যাইতেছিস, তুইতো বড়লোক হইয়া যাইবি !! ওইখানেতো ব্যাটা রাস্তায় রাস্তায় টাকা ওড়ে !!” শুনিয়া হাবলুর বক্ষখানি সেইসময় ৩ হাত প্রশস্ত হইয়া গিয়াছিলো। যদিও হাফহাতা শার্ট ভেদ করিয়া শীর্ণকায় দেহে তাহার প্রশস্ত বক্ষখানি তখন কাহারও দৃষ্টিগোচর হয় নাই। না হওয়ার কারণও আছে। তখন চান মিয়ার দোকানে আবার সকলে মিলিয়া তখন নতুন হিরো অনন্তের খালি গায়ে মারামারি দেখিতেছিলো কিনা !
যাক, সেসব পুরনো স্মৃতি মনে করিয়া কি লাভ !! হাবলু তখন ব্যস্ত ঢাকায় যাইয়া কি কি করিবে তাহার হিসাব-নিকাশে। এইসব ভাবিতে ভাবিতেই হঠাৎ করিয়া হাবলুর মস্তকখানি সামনের সিটের সাথে ঠুকিয়া গেলো। সে কিছু বুঝিতে না পারিয়া শুন্য দৃষ্টিতে ব্যথিত মস্তকে সামনে তাকাইলো। সে দেখিলো চারিদিকে কিছু দেখা যাইতেছে না। কেমন জানি উজ্জ্বল হলুদ চারিপাশে !! তাহার হঠাৎ কাশিও পাইলো। কে যেন চিৎকার করিয়া তাহার কর্ণের বারোটা বাজাইয়া কহিল জানালা বন্ধ করিতে। সে কিছুই বুঝিতেছিলো না। এইসময় তাহার এলাকার এক দুলাভাইয়ের কথা মনে পড়িল। দুবাইফেরত ওই দুলাভাই একবার কহিয়াছিলো মরুভূমিতে নাকি এমন মরুঝড় হয় যে এক হাত সামনের জিনিসও দেখা যায় না !! তৎক্ষণাৎ একটা মাপ নিয়া বুঝিতে পারিলো যে সে এখন এক বিঘা সামনের জিনিসও দেখিতে পারিতেছেনা !! মস্তকে প্রচন্ড ব্যথা আর চোখে ধুলাবালির যন্ত্রণা নিয়াও সে মনে মনে খুশিই হইলো। দুবাইয়ের মত শহরকেও পিছনে ফেলিয়াদিলো তাহার ঢাকা !! আহা বেশ বেশ !!
যাক, বেশ কসরত আর বিপুল পরিমাণ হেলাহেলির পর একসময় তাহার বাসের কন্ডাক্টর সায়েদাবাদ নামক এক জায়গায় পৌছার ঘোষণা দিলো। এখন নামিয়া যাওয়ার সময় হইয়াছে। সে তাহার ছোট ব্যাগখানি কাঁধে ঝুলাইয়া নামিয়া পড়িল। ফোনে তাহার মজনু ভাইয়ের সহিত আগেই কথা হইয়াছে। মজনু ভাইয়ের বাসা ধানমন্ডিতে যাওয়ার সকল উপায় আগেই সে জানিয়া রাখিয়াছে। সে বাস থেকে নামিয়া একখানা রিকশা নিলো। প্রথমে আরামবাগ যাইয়া তাহাকে ধানমন্ডির বাসে উঠিতে হইবে। মজনু ভাই বারবার কহিয়া দিয়াছে, “শোন হাবলু !! ঢাকায় প্রথমবার আসিতেছিস। একটু দেখিয়াশুনিয়া পথ চলিবি। তোকে আমি লোকাল বাসে আসিতে বলিতে পারিতাম, কিন্তু নতুন আসিয়াই লোকাল বাসে উঠিলে তোর সবকিছু ছিনতাই হওয়ার ভয় আছে। মনে রাখিবি, ঢাকায় শুধু চালাক লোকেরাই টিকিয়া থাকিতে পারে !!” হাবলুও কোন বাতচিত না করিয়া গুরু মজনুর কথা মানিয়া নিয়াছে। এখন সে রিকশায় চড়িয়া যাইতেছে আরামবাগের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ করিয়া কি থেকে কি হইল সে নিজেকে আবিষ্কার করিল যে সে উড়িয়া যাইতেছে। তাহার বিস্ফারিত চক্ষুতে সে দেখিল তাহার মস্তক আর রিকশাওয়ালার মস্তকের সংঘর্ষ আসন্ন !! অনিবার্য সংঘর্ষকে সে এড়াইয়া যাইতে পারিল না। একটু পড়ে চক্ষুর আধারখানি মিলিয়া যাইতে সে দেখিলো সে রিকশাতেই আছে। হাফ ছাড়িয়া বাচিলো !! একটা তীব্র কন্ঠের গালি তাহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিলো। সে দেখিলো রিকশাওয়ালা তাহার মাথার পিছনদিক ডলিতেছে আর তাহাকে গালি দিতেছে। সে ঘটনার হেতু কিছু বুঝিলো না। রিকশাওয়ালা কহিতেছে, “মিয়া ঢাকায় কি নতুন আইছেন নি ?? ঠিকমত বইতেও হারেন না ??'” হাবলু মনে মনে একটু লজ্জিতও হইলো সে আরেকটু হইলে মুখ ফুটিয়া বলিয়াই ফেলিত যে সে নতুন আসিয়াছে। কিন্তু মজনু ভাইয়ের সাবধানবাণী মনে পড়িয়া সে চুপ হইয়া গেলো। মজনু ভাই তাহাকে দিয়া আগেই শপথ করাইয়া নিয়াছিলো যে সে কম্মিনকালেও নিজেকে নতুন বলিয়া পরিচয় দিবে না। না হলে নাকি তাহার আর বাজারে বিক্রীত ছাগলের মাঝে কোন তফাৎ থাকিবে না। যাক, রিকশা আবার চলা শুরু করিয়াছে। সামনে একখানা বিশাল বাস বেশ আয়েশি ভঙ্গিমায় চলিতেছে। সে অবাক হইয়া লক্ষ করিল যে তাহার রিকশাখানি সেই বাসকে বিপুল গতিতে পাশ কাটাইয়া গেলো। বাপরে বাপ !! ঢাকায় দেখি রিকশা পাল্লা দেয় বাসের সহিত !! হাবলু বুঝিতে পারিলো যে সে যেন তেন শহরে উপস্থিত হয় নাই। ঢাকার গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া সে আরও গম্ভীর হইয়া গেলো।
আরামবাগে পৌছাইয়া সে ভাড়া বাহির করিলো। মজনু ভাই আগেই বলিয়া দিয়াছে যে ভাড়া বিশ টাকা দিলেই চলিবে। কিন্তু যেই সে বিশ টাকার নতুন নোটখানা বাহির করিলো অমনি সে শুনিতে পাহিল রিকশাওয়ালার বিদ্রুপ বাণী, “ওই মিয়া কি বাইর করেন?? আমারে কি ফকির পাইছেন নি ?? নাকি আম্নেই ফকির ?? যান যান টেকা লাগব না। কই থিকা যে আহে এইগুলান !!” হাবলু হতভম্ব হইয়া রিকশাওয়ালার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রইল। পরে সে যে ফকির না তাহা প্রমাণের নিমিত্তে একখানা পঞ্চাশ টাকার কড়কড়ে নোট বাহির করিয়া রিকশাওয়ালার হাতে গুজিয়া দিলো। তাহার বংশের কাউরে কেউ কোনদিন ফকির বলার সাহস করিতে পারে নাই। আজ তাহার জন্য সেই বংশে কালিমা লেপন হইলো বলিয়া সে মজনু ভাইয়ের উপর কিঞ্চিৎ মনঃক্ষুণ্ন হইলো।

বাসের টিকিটখানি ক্রয় করিয়া হাবলু যখন আসন গ্রহণ করিলো তখন তাহার মনে এক শান্তির সুবাতাস বহিয়া গেলো। যাক সকল ঝামেলা চলিয়া গিয়াছে, এখন এই বাসই তাহাকে যথাস্থানে পৌছাইয়া দিবে। ভাড়া নিয়া আর কোন ক্যাচাল হইবে না। আয়েশ করিয়া বসিয়া সে বাসের বাকি যাত্রিদিগের দিকে সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে থাকিলো। পুরা বাসে মাত্র ছয়জন মানুষ। এর মধ্যে ড্রাইভার আর হেল্পার বাদ দিলে বাকি থাকে মাত্র চারজন। একজোড়া ছেলেমেয়ে গা ঘেষাঘেষি করিয়া বাসের এক কোণায় বসিয়া রহিয়াছে। সে টিভি-নাটকে এমন জিনিস বহুবার দেখিয়াছে। বুঝিতে পারিলো যে তাহারা কপোত-কপোতী। তাই সে সেই দিকে আর বেশিক্ষণ দৃষ্টি আটকাইয়া রাখিলো না। তাহার সামনে বসিয়াছে দুই ভদ্রলোক। একজনের পরনে আবার স্যুট-টাই। কিন্তু সেই স্যুটওয়ালা ভদ্রলোকের সিটের উপর দিকে চাহিয়াতো তাহার চক্ষু ঢাকায় আসিয়া দ্বিতীয়বারের মত বিস্ফারিত হইয়া গেলো। সে দেখিলো উপরে লেখা, ”মহিলা, শিশু আর প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন”, সে তাহার ক্লাস এইট পাশ বুদ্ধি দিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলো যে স্যুট পড়া ভদ্রলোক মহিলাদের আসনে বসিয়া রহিয়াছে। সে ভাবিল ভদ্রলোক বোধহয় উপরের লেখা পড়েন নাই। সে উচ্চস্বরে বলিয়া উঠিল, “ভাই, এই সিটখানাতো মহিলাদের।“ ভদ্রলোক তাহার দিকে কেমন জানি বিরক্তিমাখা দৃষ্টি দিয়া তাকাইলেন। সে উল্টা হাবলুকে পাকড়াও করিলেন, “ওই মিয়া বাসে কি কোন মহিলা দাড়াইয়া আছেনি??” হাবলু নিজের ভুল বুঝিতে পারিল। সে তৎক্ষণাৎ টিভিতে দেইখা শিখা বাণী “স্যরি” উচ্চারণ করিল। সাথে সাথে সে শুনিল ভদ্রলোক বলিতেছেন, “কোথা থেকে যে এইগুলা আসে !!” হাবলু মনে মনে আবার লজ্জিত হইল। না সে এরপর আর চিন্তা-ভাবনা না করিয়া কথা বলিবে না। সে একেবারে চুপ হইয়া গেলো। সে বুঝিল ঢাকায় কথা বলিতে হইলে অনেক বুঝিয়া-শুনিয়া কথা বলিতে হইবে।

cms.somewhereinblog.net

বাস চলিতেছে। খালি বাস এখন অনেকখানি ভরিয়া উঠিয়াছে। দেদারছে যাত্রী উঠিতেছে। হাবলুর মনে খালি প্রশ্ন জাগিতেছে।, “সিটিং বাস টিকিট কাউন্টার ছাড়া থামিতেছে কেন ??” সেতো জানিত লোকাল বাস জায়গায় জায়াগায় থামে। কিন্তু এখানেতো দেখিতেছে সে উল্টা কাজকারবার। কিন্তু আগেরবারের মত সে আর ভুল করিতে চায় না। সে চুপ করিয়া থাকাই সমীচীন মনে করিলো। তাহার শান্তির নিরবতায় বাধ সাধিলো বাসে এক মহিলা উঠিয়াই। সে উঠিয়া তাহার জন্য রাখা সিটে বসিতে চাহিল। কিন্তু সেই সিটে বসা কয়েকজন দেখি উঠিতেই চাহিতেছে না। সে বুঝিতে পারিতেছিলো না আসলে কি ঘটিতেছে। সেই স্যুটপরা ভদ্রলোক আর মহিলার মাঝে ঝগড়া শুরু হইয়া গেলো। হাবলু বুঝিলো এখন তাহার চুপ করিয়া থাকা চলিবে না। তাহার বংশের কেহ কোন নারীকে অপমানতো করেই নাই, এমনকি তাহার পরদাদা যখন গ্রামের চেয়ারম্যান আছিলো তখন এক পোলারে উনি নিজ হাতে ধোলাই দিয়াছিলেন স্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগে। এখন চুপ করিয়া থাকিলে তাহার বংশের প্রতি তাহার অবিচার করা হইবে ভাবিয়া সে বলিয়া উঠিলো, “ভাই, আপাতো ঠিক কথাই বলিতেছেন। উপরেতো লেখাই আছে ইহা মহিলা সিট।“ এইবার যেন মৌচাকে ঢিল পড়িল। ভদ্রলোক হঠাৎ করিয়া হাবলুর দিকে অগ্নিদৃষ্টি ফেলিলেন। সে বলিয়া উঠিলেন, “ ঐ মিয়া !! এত লাফান কেন?? নিজের চরকায় তেল দিতে পারেন না ?? মাইয়াগো নিয়া এত চিন্তা কেন?? চেহারা সুরত দেইখাতো ভালই মনে করছিলাম। এখনতো দেখতাছি পুরাই একখান লুইচ্চা।“ হাবলু ঢাকায় আসার এক ঘণ্টার মধ্যে চতুর্থবারের মত লজ্জিত হইল। তাহাকেতো দুরের কথা তাহার বংশের কেহই কোনদিন “লুইচ্চা” অপবাদ শুনে নাই। সে অতি কষ্টে তাহার চোখের পানি ঠেকাইল। সে আরও অবাক হইয়া খেয়াল করিল পুরা বাসের লোকজন এখন তাহাকেই কি জানি কি “সুশীল” নামে সম্বোধন করিয়া উচ্চস্বরে হাসাহাসি করিতেছে। সে বেদনাভরা হৃদয়ে আরও চুপ হইয়া গেলো। সে বুঝিতে পারিলো, ঢাকায় কোথাও কিছু লেখা থাকিলে তাহা না মানাই নিয়ম। চুপ থাকা হইতেছে চালাকের লক্ষণ। সে ভিজা চোখের কোণ দিয়া লক্ষ করিলো, সেই কপোত-কপোতিদের মাঝে ছেলেটা উঠিয়া দাড়াইয়াছে। আর মহিলা ছেলের ছেড়ে দেওয়া আসন গ্রহণ করিতেছে। এত কষ্টের মাঝেও তাহার মুখের কোণে একটু হাসি ফুটিয়া উঠিল। কেন উঠিল সে নিজেই বুঝিতে পারিলো না।

(এই গল্পের সকল ঘটনা আর চরিত্র কাল্পনিক, কারও সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নহে।)

Md. Noor Faizur Reza
Author: Md. Noor Faizur Reza

আমার যে কাজ ভালো লাগে তা নিয়ে সারাদিন পরে থাকি !

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/rezanur/1126/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

6 comments

Skip to comment form

  1. হাবলুর ঢাকা দেখতে হাবলুর মতই !!!

    1. কথা সত্য !!

  2. ঢাকায় কোথাও কিছু লেখা থাকিলে তাহা না মানাই নিয়ম। হাবলুর এই দর্শনের পরিবর্তন একদিন হবেই। আমি আশাবাদী।

    1. আশাই আমাদের বাচিয়ে রাখে !! 🙂

  3. ” কিন্তু যেই সে বিশ টাকার নতুন নোটখানা বাহির করিলো অমনি সে শুনিতে পাহিল রিকশাওয়ালার বিদ্রুপ বাণী, “ওই মিয়া কি বাইর করেন?? ”

    …Feeling Habituated !! 😛

    1. Habituated feel না করে উপায় আছে !! ক্যাম্পাসে রিকশা নিয়ে বের হলেই প্রায় প্রতিদিন সবারই একই ঘটনার মুখে পড়তে হয়। :/

মন্তব্য করুন