আমেরিকার অনেক উচ্চ র্যাংকিংএর বিশ্ববিদ্যালয়ই ভর্তির জন্য জিআরই সাবজেক্ট টেস্টের স্কোর চায়। আমাদের দেশের গণিত শিক্ষার্থীদের মাঝে এই পরীক্ষাটিতে অংশগ্রহণ করার চল কম। নিজে পরীক্ষা দেয়ার জন্যে খোঁজখবর নিচ্ছি। ভাবলাম, একা একা খারাপ রেজাল্ট করা উচিত না, আর কাউকেও আমার সাথে লেজ কাটাবো। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম আমাদের দেশের অনেক গণিত শিক্ষার্থীই এই টেস্ট নিয়ে কিছুই জানে না। তাই আমি এই লেখায় ইটিএসের সাইটে গণিতের জিআরই সাবজেক্ট টেস্ট সম্পর্কে যা আছে তা মোটামুটি নিজ ভাষায় সারাংশ দেয়ার চেষ্টা করবো। ভুলত্রুটি পেলে জানাবেন, এডিট করে দিবো। আমি গাণিতিক বিষয়গুলো বাংলায় পরিভাষা করার চেষ্টা করছি না, ইংরেজি শব্দই বাংলা বর্ণে লিখছি, তাই উদ্ভট লাগলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
এই লেখা জিআরই জেনারেল টেস্টের কোয়ান্টিটেটিভ রিজনিং নিয়ে না, আগেই ঘোষণা দিলাম। এই তথ্য দেখে জিআরই জেনারেল টেস্টের প্রস্তুতি নিয়ে স্কোর খারাপ আসলে লেখক দায়ী নয়। জেনারেল টেস্টের প্রস্তুতির জন্য এই চমৎকার লেখাগুলো দেখতে পারেন। কোয়ান্ট প্রস্তুতির জন্য এই লেখা, ভার্বাল প্রস্তুতির জন্য এই লেখাটি , আর সার্বিক কিছু দেখতে এই লেখাটি।
আগে অরিজিনাল কন্টেন্ট দিয়ে নিই।
- সাবজেক্ট জিআরই সংক্রান্ত ইটিএসের মূল পাতা।
- ইটিএসের ম্যাথ সাবজেক্ট জিআরই-র পেইজ হচ্ছে এটা।
- আর এখানে আছে অফিশিয়াল প্র্যাকটিস বই।
জিআরই সাবজেক্ট টেস্টের ফি হচ্ছে ১৫০ ডলার। এটা ইটিএসে সরাসরি পে করা লাগে, জেনারেল জিয়ারির ফি পেমেন্ট করার মতই। পেমেন্ট নিয়ে বিস্তারিত কথা হবে পরের কোন পর্বে।
জিআরই সাবজেক্ট টেস্ট বছরে তিনবার হয়, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর আর এপ্রিল মাসের কোন একটা শনিবারে। সব সাবজেক্টেরই (ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ম্যাথ, ইংরেজি সাহিত্য আর সাইকোলজি) একসাথে হয়। কাজেই আপনি যদি গণিতের সাথে অন্য কোন বিষয়ের টেস্ট দিতে চান আপনাকে পরবর্তী তারিখের জন্য অপেক্ষা করা লাগবে, একইদিনে দুটো দিতে পারবেন না। জিআরই সাবজেক্ট টেস্টের নিয়ম হচ্ছে যে যতবার খুশি দিতে পারবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনি আসলে চাইলেও এক বছরে তিনবারের বেশি টেস্টটিতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।
আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুকই যেহেতু বহুল প্রচলিত, সাবজেক্ট জিআরই পরীক্ষার জন্যও একটা ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। সেখানে গিয়ে পোস্ট এবং পুরাতন ডকুমেন্ট ঘাঁটাঘাঁটি করেও আপনি তথ্য পেয়ে যাবেন। আমি এখানে সেগুলো এক করার চেষ্টা করেছি মাত্র।
এই ছিলো ভূমিকা। এবারে আসল কথায় আসি।
শুরুতে প্রশ্নের ধরন ও সিলেবাস। গণিতের সাবজেক্ট টেস্টে ৬৬টি এমসিকিউ উত্তর করা লাগে। একেকটিতে পাঁচটি করে অপশন, সঠিক উত্তরের বৃত্ত ভরাট করতে হয় ওএমআর শিটে। সময় ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট, অর্থাৎ ১৭০ মিনিট। প্রশ্নগুলো মোটামুটি এমনভাবেই আসে যেন গণিতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলের পড়াশোনা শেষ করা একজন শিক্ষার্থী সেগুলো তার কোর্সওয়ার্কের মধ্য থেকেই পায়। প্রশ্নের অর্ধেকের মত থাকে ক্যালকুলাস থেকে। বাকি অর্ধেকের অর্ধেক, অর্থাৎ চারভাগের একভাগ থাকে এলজেব্রা থেকে। বাকি ২৫ শতাংশ থাকে বিবিধ বিষয় থেকে। সমস্যা হচ্ছে, মোটা দাগে ক্যালকুলাস, এলজেব্রা আর বিবিধ হিসাব করে পড়াশোনাটা ঠাহর করতে পারা যায় না। আমি তাই কোন অংশের জন্য কোন টপিকগুলা দেখা লাগবে সেগুলোও বলে দিতে চেষ্টা করবো। আমি মোটামুটি যে তালিকা দিচ্ছি, সেটি মূলত প্রিন্সটন রিভিউ এর Cracking the GRE Mathematics Subject Test বইয়ের সূচি থেকে নেয়া। বইটি আমার মতে ভালো।
ক্যালকুলাসঃ
শুরুতেই ক্যালকুলাস ৫০ শতাংশ দেখে অনেকে ঢোক গিলেছেন আবার অনেকে খুশি হয়েছেন নিশ্চয়ই? প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পরে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর কাছেই ক্যালকুলাস থাকে বিভীষিকা, তিনি যেই প্রতিষ্ঠানেরই হোন না কেন। আবার দ্বিতীয় বর্ষেও থাকে ক্যালকুলাসের আরেকটা কোর্স, সেখানে ভ্যারিয়েবল আবার এক-দুইটা বাড়িয়ে দেয়া হয়। আবার অনেকেই হয়তো খুশি হচ্ছেন এই ভেবে যে মাত্র দুইটা কোর্সের বিষয়বস্তু রিভিশন দিলেই একদম অর্ধেক শেষ।এখানে একটা কিন্তু আছে। আমরা রিয়েল এনালাইসিস হিসেবে যা পড়ি (সিকোয়েন্স, সিরিজ, কন্টিনিউয়াস ফাংশন), আবার জ্যামিতি হিসেবে যা পড়ি (থ্রিডি লাইন, প্লেন, ভেক্টর) এইসবও আসলে ক্যালকুলাসের মাঝেই পড়ে। অর্থাৎ শুধুমাত্র লিমিট, ইন্টিগ্রেশন, ডিফারেনশিয়েশন পড়লেই হবে না, অন্য কিছু কোর্সের বিষয়বস্তুও পড়তে হবে এই ক্যালকুলাস অংশের জন্য। মোটের উপর ক্যালকুলাসের কোর্সে যা যা থাকে তা সহ গণিতের অন্যান্য কিছু অংশের (জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন ইত্যাদি) সাথে ক্যালকুলাসের সংযোগ জানা লাগবে।
- প্রিক্যালকুলাসঃ
- ফাংশন (কম্পোজিশন, ইনভার্স, গ্রাফ)
- এনালাইটিক জ্যামিতি (লাইন, প্যারাবোলা, সার্কেল, ইলিপ্স, হাইপারবোলা)
- পলিনোমিয়াল (ডিভিশন এল্গোরিদম আর রুট সংক্রান্ত থিওরেম)
- লগারিদম
- ত্রিকোণমিতি
- সিঙ্গেল ভ্যারিয়েবল ক্যালকুলাস
- সিকোয়েন্সের লিমিট
- ফাংশনের লিমিট
- কন্টিনিউয়াস ফাংশন
- ডেরিভেটিভ
- কার্ভ স্কেচিং (ডেরিভেটিভের বৈশিষ্ট্য থেকে)
- রোল, মিনভ্যালু ইত্যাদি থিওরেম
- ম্যাক্সিমাম/মিনিমাম, রিলেটেড রেট
- ইন্ডেফিনিট ও ডেফিনিট ইন্টিগ্রেশন
- ফান্ডামেন্টাল থিওরেম অফ ক্যালকুলাস
- পোলার কোঅর্ডিনেট
- এরিয়া, ভলিউম, আর্ক লেংথ
- ল’পিটাল রুল, ইম্প্রোপার ইন্টিগ্রাল
- ইনফাইনাইট আর পাওয়ার সিরিজ
- মাল্টিভ্যারিয়েবল ক্যালকুলাস
- এর জ্যামিতি
- পার্শিয়াল ডেরিভেটিভ
- ডিরেকশনাল ডেরিভেটিভ ও গ্র্যাডিয়েন্ট
- ম্যাক্সিমাম/মিনিমাম
- লাইন ইন্টিগ্রাল, ডাবল ইন্ট্রিগ্রাল, ট্রিপল ইন্টিগ্রাল (এটার সাধারণত লিমিট পরিবর্তন আসে, পুরো ইন্টিগ্রেশন করা লাগে না)
- গ্রিন থিওরেম
- ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন
- সেপারেবল, হোমোজিনিয়াস, এক্সাক্ট, ননএক্সাক্ট (মূলত লিনিয়ার)
- কনস্ট্যান্ট কোফিশিয়েন্টের হায়ার অর্ডার
- অল্প একটু পিডিই
এই হচ্ছে মোটামুটি ক্যালকুলাসের অন্তর্গত বিষয়বস্তু।
এলজেব্রাঃ
এবারে আসি এলজেব্রার কথায়। এলজেব্রার আসলে দুইটা অংশ, লিনিয়ার এলজেব্রা আর এবস্ট্রাক্ট এলজেব্রা, এবস্ট্রাক্ট এলজেব্রার সাথে নাম্বার থিওরিও আছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা এলজেব্রায় খুবই দুর্বল কারণ আমাদের গাণিতিক যুক্তি পোক্ত না। আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ হচ্ছে এই অংশেরগুলোর জন্য একটু জোর দিয়ে প্রস্তুতি নেয়া। এলজেব্রার প্রশ্নগুলিতে হিসাবের অংশ থাকে কম, একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই খুব কম সময়ে উত্তর দেয়া যায়। এখানে এলজেব্রার বিষয়গুলোও একটু পয়েন্ট করে দিয়ে দিচ্ছি।
- লিনিয়ার এলজেব্রা
- লিনিয়ার সিস্টেমের সমাধান
- ম্যাট্রিক্স
- গাউসিয়ান এলিমিনেশন
- ইনভার্স ম্যাট্রিক্স ব্যবহার করে ইকুয়েশন সমাধান
- ভেক্টর স্পেস (নাল স্পেস, লিনিয়ার কম্বিনেশন, র্যাংক, রো/কলাম স্পেস)
- ডিটারমিনেন্ট
- লিনিয়ার ট্রান্সফরমেশন
- আইগেনভ্যালু আর আইগেনভেক্টর
- নাম্বার থিওরি
- ডিভিজিবিলিটি (প্রাইম, জিসিডি, এলসিএম)
- ডায়াফেন্টাইন ইকুয়েশন
- কনগ্রুয়েন্স, ধরনের ইকুয়েশন
- এবস্ট্রাক্ট এলজেব্রা
- গ্রুপ, সাইক্লিক গ্রুপ
- সাবগ্রুপ, জেনারেটর, রিলেশন, এই সম্পর্কিত থিওরেম (যেমন ল্যাগ্রাঞ্জ)
- আইসোমরফিজম
- ফাইনাইট এবেলিয়ান গ্রুপ
- গ্রুপ হোমোমরফিজম
- রিং, রিং হোমোমরফিজম, ইন্টিগ্রাল ডোমেইন, বিভিন্ন ধরনের রিং (যেমন আর্টিনিয়ান)
- ফিল্ড
বিবিধঃ
এবারে আসি বিবিধ অংশে। বিবিধ অংশে আসলে মোটামুটি অনেক বিষয় থেকেই আসতে পারে। ইটিএসের প্রকাশ করা প্রশ্নগুলা থেকে মোটামুটি এমন একটা ধারণা করা যায় আর কী।
- লজিক
- সেট থিওরি
- গ্রাফ থিওরি
- এলগরিদম, ফ্লোচার্ট
- কম্বিনেটরিক্স
- এ সম্পর্কিত বেসিক প্রোবাবিলিটি সমস্যা
- প্রোবাবিলিটি ও পরিসংখ্যান
- প্রোবাবিলিটি স্পেস, মিন, ভ্যারিয়েন্স, নরমাল ডিস্ট্রিবিউশন
- পয়েন্ট সেট টপোলজি (বেসিক জিনিসপত্র)
- রিয়েল এনালাইসিস (Lebesgue Measure সম্পর্কিত, নাও আসতে পারে)
- কমপ্লেক্স ভ্যারিয়েবল
- পোলার/এক্সপোনেনশিয়াল ফর্ম
- রুট বের করা, লগারিদম, পাওয়ার বের করা
- কমপ্লেক্স নাম্বারের ফাংশন
- এনালাইটিক ফাংশন
- কমপ্লেক্স লাইন ইন্টিগ্রাল
- এনালাইটিক ফাংশন আর ইন্টিগ্রাল সম্পর্কিত থিওরেম
- সিঙ্গুলারিটি, পোল, লরেন্ট সিরিজ
- রেসিডিউ থিওরেম
- নিউমেরিক্যাল এনালাইসিস (হালকা)
এবারে আসি রেজিস্ট্রেশন এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথায়। সাবজেক্ট জিয়ারির রেজিস্ট্রেশন রেগুলার জিয়ারির মতই। বাংলাদেশে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সাবজেক্ট জিয়ারির সেন্টার হিসেবে কাজ করছে (এই পোস্ট লেখা পর্যন্ত)। সাধারণ জিয়ারির মতই সাবজেক্ট জিয়ারিতে রেজিস্ট্রেশন করা যায়, আলাদা কোন বিষয় নেই।
রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে বাকি থাকে প্রস্তুতি। প্রস্তুতির জন্যে আসলে পড়াশোনা ছাড়া উপায় নাই। এই গুগল ড্রাইভ ফোল্ডারে গণিতের জিআরইর কিছু বইপত্র এবং পুরাতন প্রশ্ন আছে। এছাড়াও ইউনিভারসিটি অফ শিকাগোর ওয়েবসাইটের এই ওয়েবপেইজে ম্যাথ জিয়ারির প্রস্তুতি নিয়ে তথ্য এবং বইপত্র দেয়া আছে। সেগুলা সব দেখে মনে হতে পারে অনেক কিছু। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে শুরু না করলে শেষ হবে না। তাই প্রস্তুতি সংক্রান্ত আমার একমাত্র সাজেশন হচ্ছে একপাশ থেকে শুরু করে দেন।
( আমি ভালো উপসংহার টানতে পারি না, কাজেই এলজেব্রা সংক্রান্ত একটি ইংরেজি কৌতুক দিলাম। এটা বুঝতে পারাও জিয়ারি প্রস্তুতির অংশ। কৌতুকটি নিয়েছি এখান থেকে।)
সাম্প্রতিক মন্তব্য