প্রথম বর্ষ, না যেন হয় ভুলের বর্ষ !!

তারিখটা ছিল, মার্চের ১৭, মনে হয়, সদ্যই মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে আবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হয়ে প্রথম ক্লাস করতে এসেছি, শহীদুল্লাহ হলেই ছিলাম, তখন ১০০৮ এক্স-১ এ থাকি, সারা রাত ছারপোকার কামোরে না ঘুমিয়ে ঘুমাতাম দিনের বেলা। কিন্তু প্রথম ক্লাস বলে কথা, নতুন মুখ, নতুন নতুন সাজে রমনীদের আনাগোনা না দেখলে তো আর হয়না। গেলাম ক্লাসে, ৩০৪ নাম্বার রুমে সেকশন ভেদে ক্লাস সুরু হলো, আমার রোল নাম্বার ছিল ৬০, সেকশন বি, মতিন স্যার এলেন, তেমন কিছুই ক্লাস নিলেন না, দিলেন কিছু উপদেশ বা হুমকি !!! “যদি আমি দেখি কেউ মেয়েদের সাথে নিয়ে বা মেয়েরা আমার আম্মারা আব্বাদের সাথে নিয়ে বা ছেলে বন্ধু নিয়ে ঘুরছ, তারে যেখানেই পাইমু, সেখানেই বিপদে ফেলামু, আমারে কোন না কোন যায়গায় পাবাই, হয়, ডিপার্টম্যান্টের ভাইবাতে, নয়তবা কোন চাকরীর ইন্টারভিউয়ে, নয়ত বি, সি, এস এর ভাইবাতে, যেখানেই পাইমু, আমি আটকাইয়া দিমু !!!!”, স্যারের কোর্সটার নাম ছিল লিনিয়ার এলজ্যাবরা, ভাবতে ছিলাম স্যারগো কি কন !!! এ কোন যায়গায় আসলাম, কলাভবনে আছিলাম, সেডাইতো ভাল ছিল। সেদিন এমন হুমকি শুনে যাওয়ার পর, ভাবলাম জীবনটা যে এই ডিপার্টম্যান্ট কাহীল বানিয়ে দেবে, সেটা নিশ্চিত, স্পেসিয়ালী আমাকে তো দিবেই, গান বাজানা, কালচার প্রোগ্রাম নিয়ে কাটিয়ে আসা আমি শেষ পর্যন্ত কি না নিরলস ডিপার্টম্যান্টে ভর্তি হইলাম। পরের দিন ঘুমাচ্ছি, সদ্য কেনা নোকিয়া মাল্টিমিডিয়া মোবাইলটিতে ক্যা ক্যা আওয়াজে রিং বাজতে লাগলো, বিরক্ত নিয়ে ফোন ধরলাম, রি-এডমিশেন নেওয়া এক বন্ধু আসাদ, ছাত্রদলের সেইরকম নেতা হলে, ফোন দিয়ে বলতেছে মামা চল শাপলা ম্যাডামের ক্লাস, ক্যালকুলাস, ক্লাসটা করে আসি, বললাম কি আর করা চল, ধুম-ধাম রেডি হয়ে ক্লাসে গেলাম, এক মায়াবদী মা এল ক্লাসে, খুব আস্তে আস্তে বলতেছিল, “তোমরা হয়ত অনেকেই চাওনি এই বিভাগে ভর্তি হতে, ভাগ্য নিয়ে এসেছে, কিন্তু আমি বলব, গণিতের স্কোপ পুরো বিশ্বজুড়ে, এখানে ভাল করতে পারলে সব যায়গায় এর চাহিদা আছে।”, ম্যাডামের কথাগুলো এত আস্তে বলা স্বত্বেও একদম পিছনের সাড়ীতে বসা আমার কানে স্পষ্ট শুনা যাচ্ছিল, কি অমায়িক মানুষের কথার ধরন, খুব খুব ভাল লাগছিল, তো ম্যাডাম শুরু করলেন ক্যালকুলাস লেকচার, বই রেফারেন্স দিলেন, হাওয়ার্ড এন্টন, আমার চোখে অন্ধকার নেমে এল, হায় হায় ইংরেজীতে পড়তে হবে, জীবনেওতো ইংরেজীর বানান ঠিক মত লিখতে পারিনি !!! যাক, সেদিন ক্লাস হোল আরও ২টি, একটি ফান্ডামেন্টাল অফ ম্যাথম্যাটিকস অন্যটি কার্জন হলে ম্যাকানিক্স !! ম্যাকানিক্স ক্লাসে ম্যাডাম কি যে পড়ালো আর কি করল কিছুই বুঝলাম না, তেমন গুরুত্বও দিলামনা, হলে ফিরে গিয়ে ভাবতেছি কি করা যায়?? ২য় বর্ষের রিপা আপুকে ফোন দিলাম, বললাম আপু বই লাগবে, বই দেন, আপুটা খুব ভাল ছিল, বলাতেই ১ম বর্ষের সকল বই দিয়ে দিল, রাতে ক্যালকুলাস বইটা নাড়া-চাড়া করে সিদ্ধান্ত নিলাম নাহ!! এই বই আমার পক্ষে পড়া সম্ভব না, কিন্তু করবোটা কি?? পরেরদিন শাপলা ম্যাডাম এর রুমে চলে গেলাম, ম্যাডাম কেন জানি আমাকে এতটা আন্তরিকতা নিয়ে পড়াতে লাগলেন, সেটা জানিনা, যাই হোক ম্যাডাম সাহস যোগালেন চেষ্টা করে যাও, কিন্তু চেষ্টা আর কি করব, বুঝলেতো করব?? এভাবেই দিন যাচ্ছিল, পড়ালেখা ছাড়া বাকি সব খুব ধুমধাম করে হচ্ছিল, টি, এস, সি হয়ে গেছিল আল্টিমেট ক্লাস রুম, বিশদ বলছিনা, এতটুকু শুধু বলতেছি, আমার পড়ালেখা শিকেয় উঠে গিয়েছিল, দেখতে দেখতে ইনকোর্স পরীক্ষা, প্রথম ইনকোর্স, “কো-অর্ডিনেট জিওমেট্রি”, সত্যি বলছি আমি এই কোর্সটা কিচ্ছু পরিনি পরীক্ষার আগে, পরীক্ষাতো দিতে হবে, কি যেন পরলাম, রাতে একটু, সেইটা নিয়েই পরীক্ষা দিতে গেলাম, এভাবে সব পরীক্ষা দিলাম, ফলে যা হবার তাই, ১ম বর্ষের ইনকোর্ষ পরীক্ষায় নাম্বার ৬, ৯, ৫, ৮, ১২ আরেকটা মনে পরছে না, তবে এটা ঠিক আমার সর্বোচ্চ নাম্বার ছিল ১২ যা আমি মতিন স্যারের কোর্সটাতে পেয়েছিলাম, কারন স্যারের ক্লাসে বুঝানোর জন্য, হলেতো সারা রাত রাজনীতি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সিট পলিটিক্স……ইত্যাদি করে করে টাইম পার, ল্যাবের জাহাজ হবো ভেবে কিনলাম কম্পিউটার, হয়ে গেলাম, মুভি মাস্টার, গেইমিং মাস্টার, ব্যাস আর যায় কই, জীবনটা এতটাই রজ্ঞীন যে ঢাকা বিশববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সার্থক, তো রাজনীতিতে টুক টাক গ্রুপিং হয়, সেই গ্রুপিং এর প্যাঁচ এ পরে ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগে হল থেকে হলাম বহিষ্কার, একরাতের নোটিশে রামপুরা একটি মেসে গিয়ে উঠলাম, সে যে আরেক দুনিয়া, সবাই সেখানে মিডিয়া তে কাজ করে, এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর, কিন্তু এত ভাল ছিল সবাই, রাজনীতির প্যাঁচ থেকে মুক্ত হয়ে সেখানে প্রাণ খোজে পেলাম, খুব ভাল ছিল আমার মেসমেট গুলো, কিন্তু সমস্যা একটাই, পড়ার পরিবেশ নাই, আর সাথে আমার ইচ্ছাও নাই, এমন করেই এগিয়ে যেতে থাকল দিনকাল, শুধুমাত্র নোট, বন্ধুদের সহযোগীতা, আর পরীক্ষার মাঝে অন্য এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে পড়া, এই সব মিলিয়ে আমার ১ম বর্ষের রেজাল্ট হয়েছিল, সাফল্যের সাথে ৩টাতে ফেল(ক্র্যাস)মেরে জি,পি,এ ২,২৭ যা ছিল শেষের দিক থেকে ৩য় তম। সক্ষেপে এতটুকুই আমার ভুলে ভরা জীবনের অধ্যায়ের একটি বছর, প্রথম বর্ষ।

আজ আমি ইংজিনিয়ারিং ম্যাথম্যাটিকস এ Erasmus Mundus M.Sc MathMods (www.mathmods.eu) মাস্টার্স করতেছি, বিশ্বের মোট ২১ টি দেশের ছেলে-মেয়ে এখানে পরতেছে, আমি একমাত্র বাংলাদেশী আমাদের ব্যাচে, অনেক বেসিক ম্যাথ বুঝার সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু লজ্জায় পরতে দেয়নি অন্য দেশের স্টুডেন্টদের মাঝে, সাফল্যের সাথে এই সেমিস্টার শেষ করেছি, কিন্তু কষ্ট করতে হচ্ছে, কারন সুধু একটা জিনিসি ভাবতেছি, আমিতো শুন্যের উপর ঘর বানিয়েছি, বেইসম্যান্ট এ রড, বালি, সিমেন্ট পানি কিচ্ছু নেই, হ্যা আমি বেইসম্যান্টটাকে ১ম বর্ষ বলতেছি, ইন জেনারেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর সায়েন্স ফ্যাকাল্টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক করে দেখলে চরম ভুল হবে, বিশেষ করে গণিতের মত বিষয়ে পড়তে যারা এসেছ, তাদের কাছে অনুরোধ আমি যে ভুলগুলো করেছিলাম তা তোমরা করোনা, কেননা, গণিত নিয়ে গবেষণাতে সাড়া পৃথিবীতে যত ফান্ডিং হচ্ছে, তা যে কোন বিষয়ের চাইতে অবশ্যয়ই বেশি, কম না। রাজনীতি হয়ত হলগুলোতে সাময়িক সুবিধা দিবে, কিন্তু একটা সময় সিটকে পরে যাবে জীবন থেকে, অন্তর্দহনে পুড়াবে, এমনকি নিজেকে ক্ষমা করতে পারাটা খুব কষ্ট সাধ্য হয়ে পরবে। আমি জানি আমার মত অনেকেই গ্রাম থেকে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরতে এসেছ, বাবা-মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে পাঠিয়েছে ঢাকা শহরে, যে রাজনীতিতেই জড়াবে, এতে তোমার ক্ষতিই হবে, কারন হল রাজনীতিতে সব দলের চেহারা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, যে সময়টা সেখানে ব্যায় করবে, সেই সময়টা বেইসম্যান্ট শক্ত কর, ১ম বর্ষটাকে সর্বোচ্চ মুল্যায়ন কর, নিয়মিত পরালেখা কর, না বুঝলে বড় ভাই বা আপু, বা স্যার-ম্যাডামদের কাছে যাও, বর্গমূল এও অনেক বেসিক আইডিয়া পাবে, আমি নিজেও আইগেন ভ্যাল্যু কন্সেপ্ট ক্লিয়ার করা সহ অনেক কিছুই ক্লিয়ার করেছি বর্গমূল থেকে, কোন সমস্যা বের হলে, প্রথমে নিজে ভাব, ডিপার্টম্যান্টে গিয়ে গুগোলে সার্চ দাও, ইংরেজীতে দুর্বল হলে স্যারদের কাছে চলে যাবে এটার ব্যখ্যা জানতে, ডিপার্টম্যান্টে এখন অনেক ইয়াং-ডাইনামিক টিচার আছে, ফ্রেন্ডলি, সুতরাং শিখার মাঝে সংকোচের কিছু নেই। আর সব শেষে বলি, টাকার সমস্যা থাকলে টিউশনি করাও, কিন্তু সৎ উপায়ে, গাইড পরে গিয়ে করালে লাভ নেই, কিন্তু নিজে বুঝে গয়ে যদি ভাল বুঝাতে পার, অসাধারন ফিড ব্যাক পাবে !! আর বিশেষ কি আর লিখব, তোমরা এখন যথেষ্ট ম্যাচিউরড, নিজের ভাল অবশ্যয়ই বুঝ, যাষ্ট পথভ্রমের দিক গুলি আমি তুলে আনলাম। সবার প্রতি রইল অশেষ ভালবাসা!! শুভেচ্ছা !!!

———————————-

আতিক, ইতালী।

Chowdhury_sher@yahoo.com

 

** এই লেখাটি লেখার জন্য ফাহিম নামের এক অসাধারন ছোটভাই কিছুদিন আগে স্কাইপে ম্যাসেজ করেছিল, বলতেছিল নতুন ছেলে-মেয়ে এসেছে, আপনার ১ম বর্ষের এক্সপেরিয়েন্স লিখে দেন বর্গমূলে !!!

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/leatique/2029/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

7 comments

Skip to comment form

  1. ami lucky amar kopal apnar moton hoyni. Math e ashar pore kharap lagleo mene niyechi, karon sarajibon e math er academic skill cchilo. Ekhon kosto hoy. Sohoj jinis bujhte pari na. Beshi boro hoye jawate dhoirjo dhore porteo valo laage nah 🙂

  2. tuitionir bepare bolbo, ami ekhane tuitioni kori. Koydin age exam e 100% peyechi (paper easy cchilo, sobai peto). Kintu DU te ami pere uthchilam na, aste aste sobar cheye kom partam, tarpore toh cholei elam. Kintu yes, ekhane boi ba guide kono kichui ami poranor jonne use kori na, Na parle student k pari na bolteo amar lojja nai, karon thik pothe rojgar korbo.

  3. ধন্যবাদ, তোমার সৎ উপায়ে অর্থউপার্যনের কথাটি দেখে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছি, এভাবেই নিজেকে তুমি, আমি আমরা সবাই নিজের কাছে সৎ থেকে জীবন উপভোগ করব। ভালথেকো !!!

  4. প্রথম বর্ষ, না যেন হয় ভুলের বর্ষ !!
    আপনার, আমার- আমাদের অনেকের প্রথম বর্ষের অভিজ্ঞতা কিন্তু একই রকমের।
    অনেক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই লেখাতে।
    ছোটভাইরা সেই ভুলগুলো পুনরায় করবেনা আশাকরি।

    1. ধন্যবাদ !!!

  5. ভালো এবং সত্য তুলে ধরা লেখা।

  6. “এভাবেই দিন যাচ্ছিল, পড়ালেখা ছাড়া বাকি সব খুব ধুমধাম করে হচ্ছিল, টি, এস, সি হয়ে গেছিল আল্টিমেট ক্লাস রুম”
    এই কথাটা চরম সত্য ভাই।

মন্তব্য করুন