ম্যাথ ল্যাব ২০১৪ এর খুঁটিনাটি

যারা বুঝতে বুল করি লাইচেন তাগো কই, এইডা ম্যাটল্যাব সফটওয়্যার এর টিউটোরিয়াল না, যদি টিউটোরিয়াল খুজেন আমারে কইয়েন, ইউটিউব থেইক্কা দেইক্ষা দিমু, আই কইলাম ম্যাটল্যাব হারি না।

এখানে কাজটা পাই সেই দিনে, ১ বছর আগে যে দিনে আমি আমার প্রথম পাওয়া চাকরিটা হারাই। হারাই বললে ভুল হবে, আমাকে বের করে দেয়া হয় চোখের সমস্যার কথা বলে। সে কারনে আমি কোনওসময়য়ই কোন দোকানে কাজ করতে পারতাম না, করতে গেলেই কদিনের মধ্যেই সমস্যা হতো। এই কাজটা পাওয়ার সময় ইন্টারভিউ এর সময় একটা ভুল উত্তর দিয়েছিলাম, বলেছিলাম ছেলেমেয়েদের সমস্যা হলে শেখাবো। উত্তরটা দিয়েছিলাম বাংলাদেশের চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করে। এখানে আমাকে বলা হয়েছিল যে যারাই পড়তে আসুক না কেন তাদের শেখানো আমার দায়িত্ব নয়। বরং আমার দায়িত্ব তাদের ভুলত্রুটি শুধরে দেয়া। সবই বুঝলাম, আরম্ভ করলাম কাজ। এবং নিত্য নতুন মানুষ চেনা শুরু করলাম। এখন বলতে পারি, সবরকম মানুষ না চিনলেও তাদের কথা শুনেই বলতে পারব তারা কেমন স্টুডেন্ট। যেন একেকখান পেপ্সোডেন্ট। [সরি কবিতা লিখে ফেললাম]। এখন তো দেখি আমার কাজই হচ্ছে পড়ানো, প্রফেসর এর কাজ হচ্ছে ক্লাসে ফাকি দিয়ে না পড়িয়ে নিস্পাপ পোলাপান গুলারে ম্যাথ ল্যাবে পাঠানো।

 

এ বছর প্রায় শেষ হতে চলল, আমারও পরীক্ষা চলে এসেছে। কিন্তু সবার সাথে এই ঘটনাগুলো শেয়ার না করলেই যে নয়। খালি আমিই মজা পাব কেন? আগে জানতাম এখানকার মানুষ অঙ্কে কাঁচা। এখন দেখি সেদিক থেকে বিচার করলে তাদের জন্মই হয় নি।

 

ঘটনা ১

একদিন এক মেয়ে আসলো। সে করতেসে ম্যাথ ০০৮। সবচেয়ে লোয়ার লেভেলের ম্যাথ। করতে এসে কিছুক্ষন পরেই বলে, “আপনার কাছে ক্যাল্কুলেটর আছে?” বললাম, “নাই, কেন? আর এই পরীক্ষায় তো ক্যাল্কুলেটর ব্যবহার করতে দিবে না”। সে যা উত্তর দিলো আমার সারাজীবন মনে থাকবে। “ভাই ২ আর ২ এ কত হয়?”। জীবনে অনেকদিন বাদ এমন একটা প্রশ্ন শুনলাম। শুনেছিলাম মাঝে মাঝে সহজ প্রশ্ন শুনলে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আমারও বন্ধ হয়ে গেল। চিন্তা করতে থাকলাম, বাপ মা আমারে ছোটবেলায় কেমনে যোগ বিয়োগ শিখাইছিল। মাথায় কিচ্ছু আসলো না। বললাম, “এগুলার জন্য ক্যাল্কুলেটর দিয়েও কাজ হবে না, এগুলো এমনি এমনিতেই জানতে হবে, নাহলে পরীক্ষা দেবে কিভাবে?”। সে বলল, “আমি ২ আর ২ যোগ করা পারি, আমি খালি একটু চেক করব ঠিক হইসে কিনা”। মার আমার মাথায় ২ ডা কাঠুল আর বুকে ২ খান ঝুনা নাইরকইল। এই মেয়েরে এখন আমার যোগ করা বুঝাইতে হবে? মর জ্বালা। আমি মরি না কেন, কবে মরুম? এক্ষনি মরলে ভালো হইত। যদি ওরে বলতাম ২ টা আপেল আছে আরো ২ টা আপেল নিয়ে আসলাম, কয়টা হইল তাইলেও মনে হয় বুঝত না। এইটাই যে না বুঝে সে কলেজে কেন স্কুল পাশ করার যোগ্য না।

 

বাঙালি কায়দা প্রয়োগ করিলাম, কহিলাম “হে কইন্যা, আমি এখন কিঞ্চিত প্রকৃতির বাক বাকুম ডাকে সারা দিতে যাচ্ছি, তুমি একটু অপেক্ষা কর”। সামনের রিসিপশনে মিনহাজুর ভাই বসে ছিল, বললাম “ভাই আমি একটু আসতেছি, দেখেন একটু”। ইন্সট্যান্টলি আমি উসেন বোল্ট হইয়া গেলাম। এমন একখান ভো দৌড় মারলাম কারো বাপও ধরতে পারবে না। ২ মিনিট এর কথা বলে ২০ মিনিট পরে আসলাম। ততক্ষনে মেয়ে চলে গেছে। হাপ ছেড়ে বাচলাম। এই কারনে প্রথম ম্যাথ ল্যাবের নিয়ম ভঙ্গ করলাম। তেমন কেউ যদিও ধরতে পারে নাই, তাইলে চাকরীই থাকতো না।

 

ঘটনা ২

মাসখানেক আগে এক মেয়ে আসলো। নাম হইল অ্যানা। পড়ানো শুরু করলাম। ওর পাশেই বসেছিলাম। হঠাত করেই মনে হল কোথায় জানি পায়ে ব্যাথা লাগছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝলাম সেই মেয়েটা অনবরত পা নাড়াচ্ছে। আমি কিছু বলতেও পারছি না। মনে করলাম, চাকরি পেয়েছি নতুন কাউকে কিছু বললেই আমার নামে অখুশি হয়ে কমপ্লেন করে দিবে এটাও যাবে, চুপ থাকি। কিছুক্ষন পরেই বুঝলাম ব্যাপারটা। সে শুধু আমাকে ইচ্ছে করে লাথিই মারছে না, আমাকে ঘেসে বসতে চাচ্ছে। একেবারে পারলে উপরে চেপে, ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। আমি যতই আস্তে করে ডানদিকে সরে যাই, ও ততই ডানে চেপে বসে। একসময় দেখলাম হাতের মধ্যে কি জানি কাগজ গুজে দিল। ও যাওয়ার পরে কাগজটা খুলে দেখি নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে গেছে। অন্য কেউ হলে হয়ত ভদ্রতার খাতিরে মাঝে মধ্যে ফোনও দেয়া যেত। কিন্তু ও যা করল তাতে আমার তো সব বোঝা হয়ে গেছিল। না জেনেশুনে থাকলে আমি ম্যানহোল তো দূরে থাক, ব্ল্যাকহোলে লাফ দিতে যাচ্ছিলাম।

 

ঘটনা ৩

আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে এক বন্ধু আছে ডিজায়ার নিজিগামা, খুজলেই পাওয়া যাবে। ফ্রেঞ্চ ডিসেন্ট এর মানুষ। খুবই অমায়িক একটা ছেলে। আমাদের মতন এতো অঙ্ক না জানলেও সে আমার কলেজেই পড়ে আর লিম্যান কলেজে পড়ায়, আর এখানে আসে আমার কাছে পড়তে। ডিবেট করতে পারি যে আমি এ বছরের সবচেয়ে মজার ঘটনা শুনেছি ওর কাছ থেকে। ওকে আমি ঘটনা ১ সম্পর্কে বলেছিলাম। তো সেও আমাকে এরকমই একখান ঘটনা বলে বসলো। মানুষ যে এত স্মার্ট আগে বুঝতেই পারি নাই। এখন জানি কত চাউলে কত করকি। তখন আমি চিকেন রাইস খাচ্ছিলাম, এমন বিষম খেলাম ৩০ সেকেন্ড কাশলাম। কোথায় গেল চিকেন কোথায় গেল রাইস খুঁজেই পেলাম না। হাসি থামাতে পারছিলাম না। বিএমসিসির ক্যাফেটেরিয়াটে আমাকে দেখে মানুষ তখন মনে হয় পাগলই মনে করছিল।

 

ঘটনাটা এরকম। ও একটা ছেলেকে পড়ায়। একদিন একটা সমকোণী ত্রিভুজ (ভুমি ৪, উচ্চতা ৯) দিয়ে বলল এক্স বের কর (হাইপোটেন্যুজ)। এটা তো দেখেই বলা যায় ৯৭ এর বর্গমূল হবে। কিন্তু ও বলল, “বিশ্বাস করবা না, সেই ছেলেটা এক নজরে চিত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকল আর বলতে লাগল এক্স, এক্স, এক্স……”। ৫ মিনিট নাকি সে এক্সই বলল। ডিজায়ার বলছিল, “আরে আমি তো মনে করছি আরেক আইন্সটাইন আসছে দুনিয়াতে, অঙ্ক দেখেই সল্ভ করবে, ৫ মিনিট পরে বলল, “ওহ আই নো, এক্স ইজ রাইট হিয়ার”, বলে চিত্রে যেখানে এক্স লেখা ছিল সে জায়গাটা দেখিয়ে দিল”। তখন স্বাভাবিকভাবেই ডিজায়ারের মাথা ঘুরছিল। তারপরও সামাল দিয়ে ও বলল, “হয় নাই, পিথাগোরাস দিয়ে করতে হবে”। স্টুডেন্ট বলে, “এটা কি জিনিস?”

 

এরচেয়ে ভালো মজা হয় না, এরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভুতের ভবিষ্যৎ কবে জানি পড়িয়াছিলাম। আজকালকার মানুষ এগুলা না পড়িয়া, মুখস্থ বিদ্যা করিয়া কতদিন পর, আম জাম লেচু কেলা কেঠাল সব জায়গা থেকে পড়তে শুরু করে।

 

ঘটনা ৪

আজকে ল্যাবে যেয়ে শুনি প্রফেসর ভ্লাদিমির কাকে যেন তার টেবিল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। রাশিয়ান প্রফেসর ভ্লাদিমির, পি এইচ ডি ডিগ্রী থাকার পরও ম্যাথ ল্যাবে কাজ করেন। তাকে রিমিডিয়াল ম্যাথের ক্লাস ছাড়া রেগুলার ক্রেডিটের ক্লাস নিতে দেয়া হয়না। ইংরেজির অ্যাক্সেন্ট এর সমস্যা থাকার জন্য। তার উপর আবার বয়স্ক মানুষ। প্রচন্ড ঢিলা। এক প্যারা বুঝাইতে তার ৩০ মিনিট লাগে। কিন্তু মানুষ হিসাবে অনেক ভাল। অনেক বেশি জানেন উনি। এক মেয়ে আসছে স্ট্যাটিস্টিক্স করতে। বইখাতা আনে নি, কোন নোটও নাই। প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ক্লাস নোট কই? মেয়েটা উত্তর দিল, “আমার নোট আমি ব্যবহার করি, আপনার লাগবে কেন? আপনার তো নোট থাকার কথা। নিজের নোট দিয়ে আমাকে পড়াবেন”। যেখানে ম্যাথ ল্যাবের বাইরেই নোটিশ বোর্ডে বড় করে লেখা আছে, “তোমাদের অনুরোধ করা যাচ্ছে যে এখানে আসার আগে নিজস্ব খাতা কলম এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসবে”। সামনে তখন মেহেদি বসে ছিল, আমি যাওয়ার পরে (ততক্ষনে ঘটনা ঘটে গেছে) বলল, “আমি ইচ্ছা করলে উঠে একটা মাইর দিতে পারতাম, ইচ্ছা করতেছিল। এইদেশ দেখে দিলাম না”।

 

ঘটনা ৫

আমি বাঙ্গালিদের বেশি পড়াই আজকাল কারন সবাই আমাকে চিনে গেছে আমি এখানে আছি বলে। এর মধ্যে কিছু আছে নাছোড়বান্দা। তারই একজন একদিন আমার কাছে আসলো। তার নাকি পরেরদিন পরীক্ষা, সে কিচ্ছু পারে না। কিছুক্ষন দেখালাম, পরে দেখলাম আমার সময় শেষ, বাসায় যেতে হবে নাহলে আমারে ইঁদুর শুদ্ধা ল্যাবের মধ্যে তালা মেরে রেখে যাবে, আমি রাতে লেট নাইট ডার্ক টক শো করব। বললাম আমি যাচ্ছি। সে আমারে বলে, আর মাত্র ২ টা দেখায়ে দিয়ে যান। ১ টা করতেসি তখন বলে ভাই ভুল হইছে আর ৪ টা বাকি। আমার ধৈর্য তখন চরমে যেয়ে ঠেকছে। আমি বললাম, পারব না ৮টা বাজলে চলে যাব। সে বলে, “আমার অঙ্ক না করে আপনি যেতেই পারবেন না”, বললাম, “আটটা বাজার পরে এই কলেজে আমার একটা টুকরাও খুচরা মূল্যে পাওয়া যাবে না”। ব্যাগ থেকে কিছু বের করার নাম করে সরে গেলাম, সাইন আউট করলাম চুপি চুপি, এবং ওভারকোটটা গায়ে চাপাইয়া জয় বাবা উসেন বোল্ট বলিয়া দিলাম রাম দৌড়। কে ধরে আমারে, সাইডের গেট দিয়া বাইর হইয়া গেলাম, আমি জানি শর্টকাট দিয়ে কেউ বের হবে না। তারাতারি রাস্তায় বের হয়ে দৌড় দিয়ে সাবওয়েতে ঢুকে সামনেই ট্রেন ছিল, উঠে গেলাম। পরের দিন এনায়েত ভাই আমারে ধরে বলে, ভাই আপনার সাথেই তো আসতেছিলাম, আপনি এমন দৌড় দিলেন যে দেখাই পাইলাম না। আমি বললাম, “আপনি দৌড় দিছেন বাসায় যাওয়ার জন্য আর আমি যে কারনে দিসি সে কারনে আজকে আমারে সুস্থ স্বাভাবিক দেখতে পাচ্ছেন”। ওরে সেদিন রাত ৯ টা পর্যন্ত পড়াইলেও যে ওর আর কাজ হবে না, আর আমার যে মাথার মইদ্ধে ১০ খান ইটা পড়তেছে সেটা আমি ভালই বুঝছিলাম। প্রতিদিন ম্যাথ ল্যাব থেকে বের হওয়ার পরে মাথার ভেতরটা এক্কেরে ড্রায়ার মেশিনের মতন ঘুরতে থাকে।

 

ঘটনা গুলা সত্যি। মজা লাগলে খুশি হব। চেস্টা করলাম একটু মজা এনে দেয়ার, কিন্তু আসল গল্পগুলো থেকে সরে আসি নি। ভাল থাকবেন।

Awnon Bhowmik
Author: Awnon Bhowmik

I know very little to be proud about it. Mathematics enthusiast, possess a lust for mathematical/computational knowledge

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/awnon/2943/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

1 comments

  1. অনেক মজা পেলাম।ভাইয়া ।।। শুনে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাই অনেক ভাল।।২+২ =৪ সেই ক্লাস ১ এই শিখে যায়!!!

মন্তব্য করুন