পুরানো পাগল, পুরানো প্রলাপ

অনেকদিন আগে অনিবার্য কারনবশত এখান থেকে সরে গিয়েছিলাম। প্রোফাইলটা সরাই নি। আশা ছিল কোনদিন হয়ত আবার বর্গমূলের মাঝে ফিরে আসবো। সে আশা পূরণ হয়েছে। কারণটা লিখব। লেখার আগেই বলে নেই, আমার লেখা কিন্তু পুরানো ছন্দ হারায় নি। আজকের লেখাটা পড়ে পাগলের প্রলাপ বা আধুনিক যুগের বিজ্ঞাপন মনে করলে আমার কোনই আফসোস নাই, আর জীবনে হবেও না।

বিএমসিসি কলেজে আমার প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়েছে। পুরো সেমিস্টারটাই আমার কাছে একেবারে পাগলা গারদের মতন  মনে হয়েছে। কেউ কিছু না বুঝলেও উল্টা পাল্টা বুঝিয়ে কাউকে বিপদে ফেলতে ওস্তাদ। পরীক্ষায় সবার চেয়ে আমি কম নাম্বার পেয়েছি। স্পিচ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না, কিন্তু ডিগ্রি পেতে হলে নাকি এটা নিতেই হয়। আমি খালি চিন্তা করতাম, আমি ম্যাথ পড়ি, আমি থিয়েটার আর্টস এর সাবজেক্ট নিয়ে কি করব? ওই প্রোফেসর আমাকে দেখতে পারত না। তার সাথে মেলে এমন মানুষ পাওয়াই কঠিন। তিনি হাই স্কুল ড্রপ আউট। কোনোভাবে একটা ডিপ্লোমা নিয়ে ওখানে পড়াচ্ছেন। এই সাবজেক্ট এ ২ টা প্রধান স্পিচ দিতে হয়। একটা ইনফরমেটিভ আর একটা পারসুয়েসিভ। প্রথমটায় পেলাম ১৫, পরেরটায় ১৮। কোনটাতেই ২০/২০ পাই নি। চিন্তা করছিলাম যারা কিছুই বলতে পারে না তাদেরকে ২০/২০ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে, আমি ফাইনালে কি করব। আমার পায়ে সমস্যা হয়েছে। বেশিক্ষন হাঁটতে পারি না, দৌড়ানো তো কবেই বন্ধ হয়েছে। বেশি হাঁটলে বা দৌড়ালে পা অবশ হয়ে যায়। এটাকে লেগ উইকনেস বলে। দাক্তার দেখাচ্ছি। এটা যখন শুরু হয় তখন আমি নড়তে পারি না। নড়তে গেলেই ধপাস করে পড়ে যাই। পরীক্ষার দিন লেট হয়ে গেছিল। এটা অবশ্য আমার দোষে নয়। আমি ৬ টায় উঠে সাড়ে ছ টা বা পৌনে ৭টায় বের হয়ে ৭টার ট্রেন ধরি। ২টো ট্রেন বদল করে যখন আমার নামার সময় হয়, তখন সেই স্টপের একটু আগে এসেই ট্রেন টা থেমে যায়, এবং বেশ কিছুক্ষন ওখানেই স্থির থাকে, প্লাটফর্ম না পেলে দরজাও খুলবে না, নামবো কিভাবে। যে কারনে প্রতিদিন সময়মতন বের হলেও ক্লাস ধরতে আমার দৌড়াতে হয়।

সেদিনও ব্যতিক্রম হল না। শেষে এমন উপায় হল যে টেনশনে আমি দিলাম দৌড়। তখন পা অবশ হয়ে আসছিল। পা হড়কে আছাড় খেলাম তো খেলাম একেবারে এস্কেলেটরে উঠার সময়। কোনকিছু চিন্তা করার সময় ছিল না। খালি টেনশন ক্লাসটা সময়মতন না ধরলে পরীক্ষার টাইম কম পাব। যেয়ে দেখি লেট হয়নি, লেট সাইন ইন করতে হল না। পরীক্ষা ছিল ওপেন বুক। মনে করেছিলাম প্রশ্ন কঠিন আসবে। আমার কাছে বই ই ছিল না। সেমিস্টারে কোনই বই কিনি নি, আমার প্রফেসররাও জানেন না। যে বুক ফান্ড দিয়েছিল সেটা দিয়ে বই কেনা যায় না। অভাবের সংসার। সেটা সংসারের কাজেই লাগিয়েছি। সবাই বই আর নোট দেখে পরীক্ষা দিল আমি দিলাম স্বাভাবিকভাবে। প্রোফেসর সব দেখলেন। কেউ মনে করবেন না বিজ্ঞাপন দিচ্ছি। সারা সেমিস্টার না পড়লেও তো স্পীচ এর জন্যে বই নোট কিচ্ছু লাগার কথা না। সবার আগে বের হয়ে গেলাম। অসহ্য লাগছিল। মনে হচ্চিল “এই পরীক্ষাটা গেলে এই ব্যাটার চেহারা আমার আর দেখতে হবে না। আমার কি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি তো ফেল করলাম, বাবা মার কাছে লুকালাম, এখন নাহয় এখানেও তার পুনরাবৃত্তি হবে। কেউ জানতে চায় না, বুঝতে চায় না। সবাই চায়, গ্রেড, রেজাল্ট।” অবাক হয়ে গেলাম যখন প্রফেসরের হাতে খাতা দিলাম, উনি বললেন “ওয়েল ডান।” একটা হাসি দিলেন। আমি সব বুঝে গেলাম। উনি আমাদের ছাগল বানিয়েছেন। অনেক ভালো মানুষ। আমরা যেন তাকে ভুল বুঝি তাতে বাধ্য করেছেন। তারপরও ভয় পাচ্ছিলাম, কি রেজাল্ট হাতে দেবেন কে জানে। পরীক্ষা দিয়ে ৬ ঘণ্টা ক্লাস করে ৪-৯টা কাজ করলাম, কেন যেন পা টা ব্যাথা করছিল। বাসায় আসার পরে বুঝলাম। পা এর মাংস ছেঁচে গেছে। রক্ত জমাট বেধে গেছে। আমার কোনই চিন্তা ছিল না। আমি খালি পরীক্ষার চিন্তায় ছিলাম। যাকে বলে পিউর ধ্যান।

এর পরে ছিল ক্যালকুলাস পরীক্ষা, এর জন্যে আমার পড়া ছিল খালি কোন কোন ক্ষেত্রে কেমন জিনিস কি দিয়ে কনভারজ বা ডাইভারজ করবে। স্পিচ এর এক ঘণ্টা পরেই দেই ক্যালকুলাস III exam. পরীক্ষা দিয়ে আসার পড়ে টিউটরিং সেন্টার এ গেলাম কাজ করতে [আগের লেখাগুলো যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন]। তার আগে গেলাম ক্যাফে তে। উদ্দেশ্য কিছু খেয়ে নিতে হবে নাহলে ৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারব না। কি মনে হল ইমেইল চেক করলাম। দেখলাম প্রোফেসর স্যামুয়েলস স্যার লিখেছেন, “অনন তোমার ল্যাব নাম্বার ৮,৯,১০,১১,১২ আমার কাছে নেই। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে ইমেইল কর, অথবা ছবি তুলে পাঠাও।” মাথায় বাজ পড়ল। আর কোথায় যায়, কাজ করা মাথায় উঠল। টিউটোরিং সেন্টারে যেয়ে অ্যাডামকে বললাম, “আমাকে ছুটি দাও, প্রোফেসরকে ল্যাব এর কাগজ পাঠাতে হবে”। উত্তরে সে যা বলল তাতে তো আরও পাগল হয়ে গেলাম, “প্রোফেসর স্যামুয়েলস এখানে এসেছিলেন, তোমাকে খুজছিলেন।” ছুটলাম তার অফিসে। যা মনে করেছিলাম তাই। পরীক্ষা শেষ তো প্রফেসরও শেষ, তিনি অফিসে নেই। বাসায় গেলাম। রাস্তায় থাকতেই মা’কে বললাম, আমার যা কাগজপত্র ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছ সেগুলো বের করে রেখ। বাসায় এসে খুজতেই পেয়ে গেলাম যা চাচ্ছিলাম। এখন আর এক সমস্যা। ছবি তুলে কিভাবে পাঠাই? ক্যামেরাতে চার্জ দেয়া হয় না অনেকদিন। আমার পুরানো স্মার্ট ফোনে চার্জ দিয়ে, ওটা দিয়ে ছবি তুলে ইমেইল করলাম। সাথে লিখে দিলাম। স্যার আপনি স্টিভ এবং অ্যানার সাথে আমাকে একসাথে কাজ করতে বলেছিলেন। আপনার কাছে ওদের ল্যাব রিপোর্ট থাকলে আমারটাও ওদেরটার সঙ্গে মিশে যেতে পারে। দয়া করে দেখবেন কি? “Now you don’t get to deduct my points. Professor, I suppose I’m getting an A now? I hope…” বলাই বাহুল্য, ঢাকা ইউনিভারসিটির কোন প্রোফেসরকে এই কথা বললে সে আমাকে ফেলই করিয়ে দিত, সম্ভবত ইউনিভার্সিটি থেকে বেরই করে দিত। প্রোফেসর ওই ইমেইল এর কোন উত্তর আর দিলেন না। এর ফলে আমি পেলাম আরও ভয়।

পরের দিন ছিল সামাজিক ভূগোল পরীক্ষা। অনেকেই জিজ্ঞেস করবেন অঙ্কের সাথে এটার কি সম্পর্ক? কোনই সম্পর্ক নেই। কিন্তু ব্যাচেলর্স করতে হলে এখানে ২১ ক্রেডিট লিবারেল আর্টস এর কোর্স করতে হয়। সুতরাং আমার অ্যাডভাইজার যদি আমাকে কোর্সটা ভুল করেও নিতে বলে থাকেন, আমার কোন লসের কারবার নেই। সেদিন যেহেতু আগেই চলে এসেছিলাম, কাজ করি নি। তাই ভূগোল পড়ার অনেক সময় পেলাম। কিন্তু আদৌ কি কিছু পড়লাম? আমি কোন কালেই পড়ে পরীক্ষার হলে গেছি বলেন দেখি যে এই ত্রেন্ড টা ভেঙ্গে দেব? এটা চলছে, এবং চলতেই থাকবে। আরে বাবা পরীক্ষায় যদি পড়েই যেতে হয় তাহলে সারা সেমিস্টারে পড়লাম কি? পরীক্ষা দিলাম, জানি একটা প্রশ্নে পুরো নাম্বার পাব না। তারপরও আশা রাখলাম। সবসময় যেমন রাখি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেয়ে সেগুলো কুয়াশা হয়ে যায়।

দুই দিন পরে ছিল ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন পরীক্ষা। বরাবরের মতন কিছুই পড়লাম না। কে পড়ে রে বাবা? ফটোশপ নয়ন আর কম্পিউটার নেটওয়ার্ক অনিকের সাথে ইচ্ছা মতন চ্যাট করলাম। এই দুই পাগলা ছোট ভাইদের নিয়েই আমার ফেসবুকের বেশীরভাগ সময় কেটে যায়। পরের দিন যেয়ে পরীক্ষা দিলাম। খালি মনে রাখলাম reducible differential equation এর কোন ক্ষেত্রে কি বসাতে হয়। এই একটাই ছিল আমার পড়ার মতন জিনিস। পরীক্ষার হলে প্রশ্ন পেয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখি চুল ছিঁড়ছে, এমনকি চাইনিজ গুলাও। আমি তো দেখতেসি যা মনে করসিলাম তার চেয়ে ঢের সহজ প্রশ্ন দিসে। ধাই ধাই করে করলাম না। প্রথম ২ টা করতেই আধা ঘণ্টা গেল। তার পরে কেমন যেন ভয় পেলাম। ঠেকায় পড়ে গাঁ ঝেড়ে করা শুরু করলাম। ফলের মধ্যে ফল হলো এটাই যে আমার কনভুলেশন থিওরেমই মিলল না। বুঝলাম আর আশা নাই। বের হয়ে গেলাম [সবই উত্তর করেছিলাম]। 1/a+1/b=1/c হলে নাকি a+b=c. আমার এক ফ্রেন্ড এই কাজটা করেছিল।

কিছুদিন পরেই রেজাল্ট দিল। মোটামুটি করব জানতাম। রেজাল্ট পেয়ে দেখি 4.0 পেয়েছি। আর যায় কই। এখনই আমার বর্গমূলে বিদ্যা ফলানোর দিন। আজ বাদে কাল আবার যদি ফেল করি কেউ আমার বানী শুনবে না। 😀

Understanding is the first step towards learning

পড়ার আগে শেখা, জিনিস বুঝলে তবে তো পড়ব, তা না হলে কিভাবে করব। তারপরে যে থিওরেম দেয়া থাকে সেটা নিজেই প্রমান করা যায়। আর বই লাগে না। আগেই বলেছিলাম আমার বই কেনার পয়সা ছিল না, এখনও নেই। খুব তাড়াতাড়ি হবেও না। তাই আমি এভাবেই চলব। তার মানে কিন্তু এই না যে আমি আগে অন্যভাবে চলতাম। মনে রাখবেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে আমিই সম্ভবত একমাত্র ছাত্র যে ফেল এর পর ফেল এবং তৃতীয় বর্ষে সাফল্যের সাথে ক্র্যাশের বন্যা বওয়ানর পরে আজকে এখানে এসেও সেই একই পাগলামি করে যাচ্ছি। আগে অনেক ইচ্ছা ছিল আমি ভালো করব, মানুষ আমাকে চিনবে। এখানে মানুষ আমাকে চেনেও না, আর এখন আমার দরকারও নেই। ছোট থাকতে একটা উক্তি পরেছিলাম। সক্রেটিস বলেছিলেন, “Know Thyself” নিজেকে জানো। আমি এখন কোনও চিন্তা করি না। অন্যকে নিয়ে না ভেবে, অন্য মানুষ আমার সম্পর্কে কি ভাবছে তা নিয়ে না ভেবে আমি আমার কাজটা করব।  মরার আগে আমার জানতে হবে আমি কে। মরার আগে দুনিয়াকে কিছু দিতে চাই। ভগবান যেন শুধু আমার এই আশাটা পূর্ণ করেন। [এক বরে সবকিছুই চেয়ে নিলাম, আধুনিক যুগের পোলা কি না]

ধন্যবাদ সবাইকে। কমেন্ট করলে আরও বিস্তারিত বলার আছে। আর বিরক্ত করলাম না।

Awnon Bhowmik
Author: Awnon Bhowmik

I know very little to be proud about it. Mathematics enthusiast, possess a lust for mathematical/computational knowledge

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/awnon/2382/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

2 comments

  1. চালিয়ে যাও !

  2. গুডলাক। দাদা পাগলামী করতে থাকেন। পাগলামিই জীবন।

মন্তব্য করুন