সংখ্যাতত্ত্বের গ্যালিলিও

পুরস্কারের নাম ‘আবেল প্রাইজ’, গ্ল্যামারে যার তুলনা নোবেল প্রাইজ। গণিতে কোনো নোবেল নেই বলেই ২০০৩ সাল থেকে ওই বিষয়ে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য শুরু হয়েছে ওই পুরস্কারটি। যার অর্থ মূল্য প্রায় নোবেলের সমান। ৭ লাখ ইউরোর কাছাকাছি প্রায় ৫ কোটি টাকা। যখন  এই রকম একটি পুরষ্কার পান জন টরেন্স টেট তখন বলাই যায় কৃতকর্মের সঠিক মুল্যায়ন হয়েছে।  মনে রাখা ভাল যে, বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কারের সাথে আবিষ্কারকের নাম জুড়ে দেয়া হয়। যেমন- নিউটনের গতিসূত্র,অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যা, ভ্যানডারওয়ালস সমীকরন ইত্যাদি। তেমনি জন টরেন্স টেটের আবিষ্কারের সাথে লেগে আছে তার নাম। তার আবিষ্কারের মধ্যে আছে- টেট কোহোমোলজি, টেট ডুয়ালিটি থিয়োরেম, বারসোত্তি টেট গ্রুপস, টেট মোটিভ, টেট মডিউল, টেট অ্যালগরিদম, নেরন টেট হাইট, মামফোর্ড টেট গ্রুপস, টেট আইসোজেনি থিয়োরেম, হোন্ডা টেট থিযোরেম, সেরে টেট ডিফর্মেশন থিয়োরি, টেট শাফারেভিচ গ্রুপস, সাতো টেট কনজেকচার।গণিতের এতগুলো বিষয়ে লেগে আছে তার নাম। সংখ্যার তত্ত নিয়ে কেউ যখন বক্তৃতা দিতে ঊঠেন, তখন যতক্ষনের মধ্যে তিনি টেট নামটা উল্লেখ করতে বাধ্য হন, তাকে বলে সেই বক্তৃতার টেট সূচক।টেট সূচক সাধারনত কম হয়। অর্থ্যাত বক্তৃতার শুরু করার অল্পক্ষনের মধ্যে টেট উদ্ভাবিত কোনও না কোনও আইডিয়ার প্রসঙ্গ না টেনে এনে উপায় থাকে না। গণিত গবেষনায় এতটাই গুরুপ্তপূর্ণ ব্যক্তি তিনি। টেটের গবেষনা সংখ্যা নিয়ে।  অর্থ্যাৎ গনিতের আদিমতম শাখা নিয়ে। এ শাখার মাধুর্যে পন্ডিতেরা মুগ্ধ যুগ যুগ ধরে। পিথাগোরাস বলেছিলেন, ‘সংখ্যা সব কিছুর নির্যাস।’ জার্মান গণিতজ্ঞ লিওপোল্ড ক্রনেকার বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর সংখ্যা আবিষ্কার করেছেন, বাকি সব মানুষের কাজ।’ আরও এক জার্মান গণিতজ্ঞ কার্ল ফ্রিডরিখ গাউস বলতেন, ‘গণিত হলো বিজ্ঞানের রানি, আর সংখ্যার তত্ত্ব গণিতের রানি।’
আর টেট এই সংখ্যা নিয়েই কাজ করেছেন।
সত্যি, সংখ্যা জিনিসটা একদিকে যেমন সহজ-সরল, অন্যদিকে তেমনই জটিল ও রহস্যময়। এমনই বিপজ্জনক জিনিস হলো মৌলিক সংখ্যা। যেমন, ২,৩,৫,৭, ১১… ইত্যাদি। অর্থাৎ, যারা অন্য দুই বা তার বেশি সংখ্যার গুণফল নয়। সেই কোন যুগে ইউকিড প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ওরকম সংখ্যার শেষ নেই। তারপর থেকে যত গোলমাল। ২-এর পরের মৌলিক সংখ্যাটি ৩, অথচ, ৭-এর পরের মৌলিক সংখ্যাটি হলো কি-না ১১।

কোন একটি মৌলিক সংখ্যা জানা থাকলে, তার পরেরটি কি হবে, তা বলার কোন নিয়ম এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাননি কোন পণ্ডিত। ফলে মৌলিকরা হয়ে উঠেছে এক অপার রহস্য। তাদের ঘিরে হাজারও প্রশ্ন। যাদের অধিকাংশেরই উত্তর জানা নেই। অথচ, মজার ব্যাপার, মৌলিক সংখ্যার চরিত্র ও রকম বিচিত্র বলেই কিন্তু আপনার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কেবল আপনিই কোন কিছু কিনতে পারেন। আপনাকে পাঠানো ই-মেল অন্য কেউ পড়ে ফেলতে পারে না। ৬০ বছর ধরে মৌলিক এবং অন্য সংখ্যার চরিত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন টেট। শুরম্ন করেছিলেন ২৪ বছর বয়সে পিএইচডি থিসিস দিয়ে। টেট থিসিস নামে মূল্যবান সেই তত্ত্ব এখনও বিশেষজ্ঞদের নানা কাজে লাগে। ছয় দশক ধরে টেট যে সব বিষয়ে চর্চা করেছেন, সে সব কাজে লাগে মোবাইল ফোন, স্মার্ট কার্ড, এ মনকী, এয়ারপোর্টে প্লেন ওঠানামার নিয়ন্ত্রণেও। টেট গনিতে মজে গিয়েছিলেন শৈশবেই। বাবা ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক যিনি ছেলেকে কিনে দিতেম বিভিন্ন গনিতের ধাধার বই। আর সেই সব বই পড়েই টেট গনিত বিষয়ে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কলেজে যদিও প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ফিজিক্সে, তবে অচিরেই বুঝেছিলেন তার ভালবাসা অন্যত্র। তাই তিনি অল্প সময়ের মধ্যে বিষয় বদল করেছিলেন। টেট আবেল পাওয়ায় খুশি আমেরিকান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির প্রেসিন্ডেট জর্জ আন্ড্রুজ। বলেছেনঃ গত শতাব্দীর শেষ অর্ধের এবং এই শতাব্দীর প্রথম দশক জুড়ে সংখ্যা তত্তের বড় বড় অগ্রগতির পিছনে রয়েছে টেটের চিন্তা।  অক্সফোর্ডের গনিতবিদ দু সাতোও এর মতেঃ  “টেলিস্কোপ যেমন সহসা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সামনে মেলে ধরেছিল নতুন নতুন গ্রহ, তারা টেটের গবেষনার ফলেও তেমনি আধুনিক গনিতবিদের সামনে খুলে গেছে সংখ্যা জগতের দূর দূরান্ত। সত্যি সত্যি টেট কে সংখ্যাতত্তের গ্যালিলিও আখ্যা দেয়া যায়”।

ইমরান হোসেন
Author: ইমরান হোসেন

কি পারি আর কি পারি না নিজেই তা জানি না

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/imranhossain/865/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

4 comments

Skip to comment form

  1. টেট সম্পর্কে অনেক ট্যাঁটনা(তথ্যপূর্ণ) লেখা ।অসাধারন ।

    1. আপনাকেও ধন্যবাদ 🙂

  2. তথ্যপূর্ণ অসাধারণ একটি লিখা 😀 গণিতবিদ জন টরেন্স টেট এর সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য পেলাম 😀

    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে 🙂

মন্তব্য করুন