গণিতের রাজপুত্র যার মগজের ওজন ১৪৯২ গ্রাম

আজ একজন গণিতবিদের গল্প বলব, যার ছোটবেলায় তার স্কুলের শিক্ষকেরাও তাঁকে নিয়ে ভয়ংকর বিপদে থাকতেন। একদিন এক শিক্ষক তাঁকে জব্দ করার ফন্দি আঁটলেন। ক্লাসে এসে বললেন, “শোন ছাত্ররা, ১+২+…+১০০ – এই যোগফলটি বের কর।”
ছোট ছোট বাচ্চাদের তো তখন ত্রাহি মাম দশা। এতগুলো সংখ্যা যোগ করতে সবার গলদর্ঘম অবস্থা। কিন্তু একটু পরে দাঁড়িয়ে পড়লেন একজন ছেলে, তাঁর ক্লাসের কাজের খাতাটি নিয়ে গেলেন স্যারের কাছে।
খাতায় যা লিখা ছিল তা দেখে অবাক ঐ শিক্ষক-
S = 1 + 2 + 3 + … + 100
S = 100 + 99 + 98 + … +1
=> 2S = 101 + 101 + 101 + … +101 = 100.101
=> S =5050

সবার এতক্ষন বুঝে ফেলার কথা, কার কথা বলছি। অসামান্য প্রতিভাবান এই গণিতবিদের নাম কার্ল ফ্রেডরিক গাউস। যার মস্তিষ্কের ভর ১৪৯২ গ্রাম এবং সেরেব্রাল এলাকা ২,১৯,৫৮৮ বর্গ মিমি। সুগঠিত মোচড়ও সেখানে আবিষ্কৃত হয়, যাকে ২০ শতকের গোড়ার দিকে তার অসামান্য প্রতিভার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

carl-f-gauss

ইয়োহান কার্ল ফ্রিড্‌রিশ গাউস (১৭৭৭–১৮৫৫), ক্রিস্তিয়ান আলব্রেশট জেনসেন অঙ্কিত।

 

 

ছোটবেলার তার গাণিতিক প্রতিভা নিয়ে আরো অনেক গল্প শোনা যায়। গণিতে তার বিভিন্ন অবদানের জন্য তাকে বলা হয়ে থাকে সর্বকালের সেরা গণিতবিদ। অনেকে বলে থাকে গণিতের যুবরাজ। যুবরাজ বলা হলেও তিনি কিন্তু জন্মেছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে। বাবা শ্রমিক, আর মা অন্যের বাসার পরিচারিকা। গাউস জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৩০ এপ্রিল ১৭৭৭ সালে জার্মানীতে। তার সময় বা আগে জার্মানীতে তেমন নামীদামী গণিতবিদ ছিল না। ১১ বৎসর বয়ছে প্রাথমিক পড়াশোনা করে ভর্তি হলেন হাইস্কুলে। অবশ্য এই জন্য তার বাবাকে অনেক কষ্টে রাজী করান তার মা। হাইস্কুলে তিনি অসাধারণ ফলাফল করলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি শহরের ডিউক থেকে একধরনের বৃত্তি পেয়ে গেলেন যে কারণে তার পড়াশোনার খরচ চালানো অনেক সহজ হয়ে গেল।

হাইস্কুল ছেড়ে কার্নোলিয়াম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি দেখলেন, পাঠ্যসূচীর অনেক কিছুই তিনি নিজে আবিস্কার করে ফেলেছেন। তার বিখ্যাত প্রাইম নাম্বারের সূত্রটি আবিস্কারের ১০০ বছর প্রমানিত হয়েছে।
[important]প্রাইম নাম্বার সূত্রঃ
ধরি π(x) হচ্ছে মৌলিক সংখ্যা গণনাকারী ফাংশন যা কোন স্বাভাবিক সংখ্যা x-এর সমান বা ছোট মানের মৌলিক সংখ্যার সংখ্যা প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, π(10) = 4 কারণ চারটি মৌলিক সংখ্যা আছে (২, ৩, ৫ ও ৭) যেগুলি ১০-এর সমান বা ছোট। মৌলিক সংখ্যা উপপাদ্য বলে যে, যদি x-এর মান অসীমের নিকটবর্তী হয়, তবে π(x) এবং x / ln(x) ফাংশনদ্বয়ের ভাগফলের সীমা ১।[/important]

কলেজ শেষ করে এলেন জার্মানির গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে এসেই তিনি একের পর এক বই পড়তে লাগলেন। তিনি নতুন করে আবিস্কার করলেন, তার আবিস্কার করা অনেক কিছুই মৌলিক নয়। তিনি গণিতের প্রতি মোহভঙ্গ হলেন। ঠিক করে ফেললেন, ভাষাবিদ হবেন। ঠিক সেই সময়ে তিনি দুই হাজার বছরের পুরোনো একটা সমস্যার সমাধান করে সবাইকে তাক করে ফেললেন। সমস্যাটা ছিল রুলার ও কম্পাস ব্যবহার করে সতেরভুজ আঁকা।

প্রায় বৃত্তাকার সতেরভুজ

প্রায় বৃত্তাকার সতেরভুজ

 

এই সমাধানই গাউসকে ভাষাবিজ্ঞানের পরিবর্তে গণিতকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে অনুপ্রাণিত করে। গাউস তার এই উদ্ভাবন নিয়ে অত্যন্ত গর্ববোধ করতেন এবং তার ইচ্ছে ছিল তার স্মৃতিফলকে একটি সুষম হেপ্টাডেকাগন (সতেরভুজ) খোদাই করা থাকবে। তবে কারিগররা এতে অপারগতা প্রকাশ করে, কারণ সতেরভুজ খোদাই করা বেশ কঠিন ব্যাপার ছিল, এবং এই শ্রমসাধ্য সপ্তদশভুজকে ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে বৃত্তের সাথে পার্থক্য করা যেত না।

ভিডিওঃ রুলার ও কম্পাস ব্যবহার করে সতেরভুজ আঁকা।

তিনি মডুলার এরিথমেটিক আবিষ্কার করেন, যা সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশ বহুগুণ সহজতর করে। কোয়াড্রাটিক রেসিপ্রোসিটি নিয়মটি প্রমাণ করেন। এই অসাধারণ সাধারণ সূত্রের মাধ্যমে কোন দ্বিঘাত সমীকরণ মডুলার পাটীগণিতের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব কিনা তা নির্ধারণ করা যায়। গাউস আরও আবিষ্কার করেন যে, সকল ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যাকে সর্বোচ্চ তিনটি ত্রিভুজীয় সংখ্যার যোগফল হিসেবে প্রকাশ করা যেতে পারে; তিনি সসীম ক্ষেত্র সহগ বিশিষ্ট বহুপদীর সমাধান সংখ্যার ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যা ১৫০ বছর পর ভেইল অনুমিতির জন্ম দেয়।

গাউস এলজেব্রার মূল চারটি থিওরেম প্রমাণ করে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর অসংখ্য নতুন জিনিস নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। এর আগে গণিতের যতকাজ হয়েছে সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। অতীতের অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন, যেগুলো এখনও ব্যবহার করা হয়। গণিতের বিভিন্ন শাখায় তার গবেষনার তালিকা এতই দীর্ঘ যে, একজন সাধারণ মানুষের কাছে তা হৃদয়ঙ্গম করা আসলেও অসম্ভব। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ ডিসকিশিয়নেস অ্যারিথমেটিকা লেখা সমাপ্ত করেন, যা ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর এই কাজ গণিতের একটি পৃথক শাখা হিসেবে সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে এবং আজও এর প্রভাব অপরিসীম।

গাউসের ভাস্কর্য ব্রাউনশভিগে গাউসের জন্মস্থানে তাঁর মূর্তি।

গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক হওয়ার চেয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে তার অনেকবেশী ভালো লাগতে থাকে। ইতালীয় জ্যোতিরবিজ্ঞানী জিওসেপ্পে পিয়াজ্জি বামন গ্রহ সেরেস আবিষ্কার করেন, কিন্তু তিনি মাত্র কয়েকদিন গ্রহটি পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হন। গাউস গ্রহটির অবস্থান সঠিকভাবে হিসাব করে খুব অল্পসময়ের মধ্যে পুনরায় একে খুঁজে পাওয়ার পথ বাতলে দেন। ফ্রাঞ্জ জাভের ফন জাখ গোথায় গ্রহটি পুনরাবিষ্কার করেন এবং তার এক দিন পর হাইনরিখ অলবার্সও ব্রেমেনে বসে গ্রহটি খুঁজে পেতে সমর্থ হন। জাখ মন্তব্য করেন, ডক্টর গাউসের বুদ্ধিদীপ্ত গণনা ভিন্ন আমরা হয়তো গ্রহটি আর খঁজে পেতাম না। যদিও তখন পর্যন্ত গাউস ডিউকের কাছ থেকে বৃত্তি পাচ্ছিলেন, তিনি এই ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তাছাড়া তিনি মনে করতেন বিশুদ্ধ গণিত অর্থনৈতিক সহায়তা লাভ করার মত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে চাকরি খঁজতে শুরু করেন এবং ১৮০৭ সালে গোটিগেনের জ্যোতির্বিজ্ঞান অবজার্ভেটরির প্রফেসর অফ এস্ট্রনমি ও ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ চাকরিতে বহাল ছিলেন।

সেরেস বামন গ্রহ সেরেস খুঁজে পাওয়ার পথ বাতলে দেন গাউস

খ্রীস্টপূর্ব ৩০০ সাল থেকে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই হাজার বছর ধরে জ্যামিতি বলতে শুধুমাত্র ইউক্লিডের “The Eliments” বইটি। ইউক্লিডিয় জ্যামিতি হলো ইউক্লিডের ৫ টি মৌলিক স্বীকার্যের সাহায্যে যেসব তত্ত্ব আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি। কিন্তু পঞ্চম স্বীকার্যবাদে প্রমাণিত তত্ত্বগুলোকে নিয়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সম্ভাবনার কথাও গাউস আবিষ্কার করেছিলেন বলে দাবি করা হয়, কিন্তু এ সম্পর্কে তার কোন কাজ তিনি প্রকাশ করেন নি। তবে এই বিষয়ে তার একটি চিঠিতে পাওয়া যায়, এর প্রশংসা করা আমার জন্যেও গৌরবের। কারণ কাজটির প্রায় সম্পূর্ণ অংশই…. আমার এ সংক্রান্ত গত তিরিশ বা পয়ত্রিশ বছরের চিন্তা-ভাবনার সাথে মিলে যায়।
গাউসের পুরনো ছাত্র ওয়ালডো ডানিংটন জানান গাউসের মতো প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি আবিষ্কারের সকল যোগ্যতাই ছিল, তবে তিনি এ সংক্রান্ত কোন কাজ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন, কারণ তিনি ভেবেছিলেন তা বিতর্কের সৃষ্টি করবে।

গাউসের বক্ররেখা

গাউসের বক্ররেখা

হ্যানোভারে সংঘটিত জরিপ অন্তরক জ্যামিতির প্রতি গাউসের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে, গণিতের যে ক্ষেত্রে বক্ররেখা এবং তল নিয়ে কাজ করা হয়। অন্যান্য অনেক কিছুর মতো তিনি গাউসীয় বক্রতার ধারণার জন্ম দেন। এ ধারণাই ১৮২৮ সালে Theorema Egregium (ল্যাটিনে অবিস্মরণীয় তত্ত্ব) এর আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত করে, যা বক্রতার ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করে। সহজ কথায় বলতে গেলে তত্ত্বটির মূল কথা হল কোন তলের বক্রতা তলটির ওপরে কোণ ও দূরত্ব মেপে সম্পূর্ণরূপে নির্ণয় করা যায়। এর মানে হল, ত্রিমাত্রিক বা দ্বিমাত্রিক স্থানে কোন তল কেমন করে গাঁথা আছে তার ওপর বক্রতা নির্ভর করে না। তাকে রয়েল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস এর বিদেশী সদস্যপদ দেওয়া হয়। পদার্থবিজ্ঞানেও গাউস অবদান রাখেন। চুম্বক ও চুম্বক ক্ষেত্র নিয়ে বিভিন্ন গবেষনায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

গাউস স্মরণে প্রকাশিত ডাকটিকিট

গাউস স্মরণে প্রকাশিত ডাকটিকিট

গণিতবিদ হিসেবে জগতজোড়া নাম করা হলেও সাংসারিক জীবনে অসুখী ছিলেন গাউস। প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যু, দ্বিতীয় স্ত্রীর অসুস্থতা, সন্তানদের সাথে খারাপ সম্পর্ক, জার্মানীর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক টানপোড়ন সব মিলিয়ে ভালো ছিলেন না তিনি। তারপরও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অবদান রেখে গেছেন। ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখে তিনি গোটিজেনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

গাউসের সমাধি

গাউসের সমাধি

গাউসের অবদান
গাউস সম্পর্কে আরো বিস্তারিত পাঠ

সূত্র(Source):
সবচেয়ে বেশী তথ্য নেওয়া হয়েছে উইকিপিডিয়া(Wiki) থেকে। এছাড়াও মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের “নিউরনে অনুরণন” বইয়ের “কার্ল ফ্রেডরিক গাউস” প্রবন্ধ এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন আর্টিকেল থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। ছবিগুলো নেওয়া হয়েছে গুগল ইমেজ সার্চ হতে।

চন্দ্রশেখর
Author: চন্দ্রশেখর

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/chondro/3308/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

7 comments

Skip to comment form

  1. ভালো লাগছে ভাই, সেই লিখছেন

    1. ধন্যবাদ।

  2. চান্দু লেখাডা সেরাম হইছে 😀

    1. পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

  3. এই ব্যাটা এত কিছু করে গেছে কেন? 🙁

    1. আমিও তাই ভাবতেছিলাম। সবকিছুতো আর বুঝিনা… তবে তার কাজগুলো ব্যাখ্যা করলেও অনেককিছু জানতাম।

  4. তিনি ভাষাবিদ হইলেই ভালো হইত !! :v

Leave a Reply to রকিবুল ইসলাম রফিক Cancel reply