বিটকয়েন ব্যবচ্ছেদ

বছর তিনেক আগের কথা। নেট ঘাটতে পেয়ে গেলাম ডীপ বা ডার্ক ওয়েবের খোঁজ। সবাই গুগল সম্পর্কে জানি। যেকোন কিওয়ার্ড দিয়ে সার্চ দিলেই লক্ষ ফলাফল চোখের সামনে। কত তথ্য গুগলে!!! তাই না? কিন্তু গুগল বা আমাদের দৃশ্যমান ইন্টারনেট জগতের বাইরেও অনেক তথ্য আছে(গুগলে ইন্টারনেট জগতের মাত্র ১০% তথ্য আমাদের দেখাতে পারে)।।

ডার্ক ওয়েব

ইন্টারনেট জগত (বড় করে দেখতে ক্লিক করুন)

http://hiddenwk7qnvvpfo.onion/
উপরের লিঙ্কটা একটা ওয়েব সাইটের ঠিকানা। বিশ্বাস হচ্ছে? দেখতে হাবিজাবি মনে হলেও এটা আসলে একটা লিঙ্ক। ডার্কওয়েবের একটা উইকির লিঙ্ক। সাধারণ ব্রাউজার দিয়ে আপনি ডার্কওয়েব ভ্রমণ করতে পারবেন না। বিশেষ ব্রাউজার কিংবা আপনার নেটওয়ার্কিং দক্ষতার সাহায্যে ঘুরে আসতে পারবেন আজব এই দুনিয়া। বলে রাখা ভালো, ভালো কাজের চেয়ে খারাপ কাজের জন্যই ডার্ক ওয়েব প্রসিদ্ধ। উইকিলিক্সের মতো ভালো উদ্যোগ যেমন এই ওয়েব ব্যবহার করে। তেমনি নেশার দ্রব্য – কন্ট্রাক্ট কিলিং -এর মতো ভয়াবহ ব্যাপারগুলো ডার্কওয়েবে হয়ে থাকে। ডার্কওয়েবে বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ কেনা বেচা হয়। ক্রেতা বিক্রেতার পরিচয় গোপন রাখার জন্য ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরণের ভার্চুয়াল মুদ্রা, বিটকয়েন।

বিটকয়েন

আজকে বিটকয়েন নিয়েই আলোচনা করব। কিভাবে এই মুদ্রা ব্যবস্থা কাজ করে, তা আমি নিজে যতটুকু বুঝেছি তাই বোঝানোর চেস্টা করব।
বিটকয়েন চালু হয়েছে ২০০৯ সালের দিকে। পরিচয় অজানা সাতোশি নাকামোতা নামের কেউ একজন বা কোন সিক্রেট একগ্রুপ চমৎকার এই মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করেছিল। প্রথম অবস্থায় এটা শুধু ডার্কওয়েবের বিনিময় মাধ্যম হলেও, বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়ছে বা শিথিল করা হয়েছে। সম্ভবত বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালে বিটকয়েনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, যা এখনো বিদ্যমান।

ধরুন, নিবিড় অননদাকে আমেরিকাতে একটা গোপন কর্ম সাধন করাতে চাচ্ছে। সেজন্য অননদা চার্জ করেছে ২০ বিটকয়েন। নিবিড় ও অননদা দুজনেই নিজেদের পরিচয় গোপন করে এই লেনদেনটি সম্পন্ন করতে পারবে বিটকয়েনের মাধ্যমে।

সাধারণ মুদ্রা যেমন কাগজের বা ধাতব হয়, বিটকয়েন থাকে কম্পিউটারে একটা ফাইল আকারে। নিবিড়ের ফাইলে যদি ৫০ বিটকয়েন থাকে, তবে সে অননদার ফাইলে সে ২০ বিট কয়েন পাঠাবে। বাকী ৩০ বিটকয়েন নিজের ফাইলে রাখবে। পুরো ব্যাপারটাই ঘটবে একটা ডিসেন্ট্রালাইজড প্রসেসে P2P নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

এখন আমরা কয়েকটা টার্ম নিয়ে সামান্য ধারণা নিব।

১। ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ ফাংশনঃ প্রথমে হ্যাশ ফাংশন সম্পর্কে জানি। এটা এমন একটা ফাংশন আপনি যেকোন তথ্য স্ট্রিং দিলে এটা নির্ধারিত সংখ্যক স্ট্রিং এ পরিণত করবে। সহজ করে দেই, আপনি ওয়েব সাইট গুলোতে যে পাসওয়ার্ড দেন, নিরাপত্তার খাতিরে সেগুলো সরাসরি ডাটাবেজে সেইভ না করে একটা ফাংশনের মাধ্যমে সেটাকে একটা নির্ধারিত সংখ্যক অক্ষরের শব্দে পরিণত করে, যাকে হ্যাশ বলে, যা থেকে আর সেই পাসওয়ার্ডে ফেরত যাওয়া সম্ভব না। আপনি যখন সেই পাসওয়ার্ড দিয়ে লগিন করতে যাবেন তখন আপনার পাসওয়ার্ড পুণরায় হ্যাশে রূপান্তরিত হবে এবং ডাটাবেজের হ্যাশের সাথে মিললে আপনি লগিন এক্সেস পাবেন। MD5, SHA1, অথবা SHA2 হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের হ্যাশ ফাংশন। এখানে মনে রাখা জরুরী, অনেক গুলো হ্যাশ ফাংশন পর্যালোচনা করলেও কোন এলগরিদম পাবেনা, যার মাধ্যমে আপনি আবার সেই হ্যাশের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবেন। ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ ফাংশন আধুনিক ধরণের হ্যাশ ফাংশন। বিটকয়েন প্রযুক্তিতে SHA2 ব্যবহার করা হয়।

ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ ফাংশন

ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ ফাংশন

২। ডিজিটাল সিগনেচারঃ এটা একধরণের গাণিতিক স্কিম, ডাটার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। ধরুন আপনার কম্পিউটারের কোন একটা সফটওয়্যার থেকে ডাটা তৈরি করে পাঠিয়েছেন ডিজিটাল সিগনেচার সহ, পরবর্তীতে ঐ ডাটা আপনার কি তা ওই ডিজিটাল সিগনেচারের মাধ্যমে বের করা সম্ভব। ডিজিটাল সিগনেচার তৈরির জন্য দুই ধরণের তথ্য প্রয়োজনীয়। একটা হলো সাইনিং কি, আরেকটা ভেরিফিকেশন কি। সাইনিং কি সবসময় প্রাইভেট কেউ এটা জানেনা। আর ভেরিফিকেশন কি পাবলিক। আপনার প্রদান করা ডাটাকে প্রথমত হ্যাশে রূপান্তরিত করা হয়। তারপর আপনার সাইনিং কি আর ওই হ্যাশ মিলেয়ে গাণিতিক পদ্ধতিতে ধরা যাক SD (Data with that signing key) বানানো হলো। এখন SD,আপনার ডাটা আর ভেরিফিকেশন কি তিনটি মিলিয়ে আরেকটা গাণিতিক পদ্ধতির মাধ্যমে বলে দেওয়া সম্ভব ডাটা আসলেই ওই সাইনিং কি এর দ্বারা তৈরি কিনা অর্থাৎ আপনি তৈরি করেছেন কিনা।

ডিজিটাল সিগনেচার

ডিজিটাল সিগনেচার

৩। Proof of work system: প্রচুর পরিমাণ কম্পুউটেশনাল ইফোর্ট প্রয়োজন হয় proof of work এর জন্য। মুলত খুবই কঠিন পাজল বা ধাঁধা টাইপ ব্যাপার এইটা। ধরাযাক একটা একটা চ্যালেঞ্জ স্ট্রিং c দেওয়া হল। এখন এমন একটা প্রুফ অব রেসপন্স স্ট্রিং p বের করতে হবে, যা নির্ধারিত গাণিতিক প্রক্রিয়ার c এর সাথে মিলে একটা ২৫৬ বিটের ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ তৈরি করবে, যার প্রথম ৪০ বিট ০ হবে। একটার পর একটা p ধরে কম্পিটারকে এই কাজ করতে হবে। হয়তো প্রথমবার ধরাতেই প্রথম ৪০ বিট সমৃদ্ধ হ্যাশ পাওয়া যাবে অথবা চেস্টা করতে হবে অনেক। ৪০ বিট শূন্য আনার জন্য গড়ে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন বার চেস্টা করতে হবে। যদি ৪১ টা শূন্যের কথা বলা হয়, এই চেষ্টার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বিটকয়েন প্রযুক্তি, স্প্যাম ইমেইল সনাক্তকরণ প্রভৃতি কাজে এই সিস্টেম ব্যবহার করা হয়।

 Proof of work system

Proof of work system

ফিরে আসি নিবিড় ও অননদার কথায়। নিবিড়ের ও অননদার দুজনেরই সাইনিং কি যথাক্রমে SKn ও SKa এবং ভেরিফিকেশন কি VKn ও VKa। নিবিড় যখন অর্ডার দিবে 20 Btc অননের কাছে পাঠাও তখন নিবিড় দ ুইটা ডিজিটাল সিগনেচার করবে। একটা ২০ BTC পাঠানোর , আরেকটা সে ধরা যাক ট্রান্সফার fee বাবদ 2 btc দিয়ে বাকী ২৮ Btc নিজের কাছে আনার সিগনেচার। যখনই সে অর্ডার দিবে তখনই p2p এর মাধ্যমে পুরো বিটকয়েন নেটওয়ার্কে চলে যাবে নিবিড়ের সিগনেচার করা তথ্য।

ডাটা মাইনারঃ বিটকয়েন নেটওয়ার্কে নিবিড় ও অননদার ট্রান্সেকশন ভেরিফিকেশনের জন্য ডাটামাইনারেরা কাজ করে। ধরা যাক বিটকয়েন নেটওয়ার্কে ১০০০ জন ডাটা মাইনার শক্তিশালী সিপিউ সমৃদ্ধ কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে। নিবিড় ও অননদার ট্রান্সেকশনের মতো আরো অনেক ট্রান্সেকশনের খবর এই ১০০০ ডাটা মাইনার পাবেন। একটি নির্ধারিত সময়ে যতগুলো ট্র্যান্সেকশন হবে তার সবগুলো মিলিয়ে একটা হ্যাশ করা হবে। এটাই হল চ্যালেঞ্জ c. এবার আগে এই ১০০০ জন পাল্লা দিয়ে খোঁজা শুরু করবে সেই কাঙ্খিত প্রুফ অব রেসপন্স p যার জন্য নির্ধারিত প্রথম কিছু বিট শূন্য। হবে। যে ডাটা মাইনার আগে এইটা করতে পারবে সে রেওয়ার্ড হিসেবে কিছু বিটকয়েন পাবে, যেগুলো প্রথমবারের মত বিটকয়েন সিস্টেমে যোগ হবে। p পাওয়ার সাথে সাথে সব গুলো ট্রান্সেকশনের হ্যাশ আর p মিলিয়ে একটা ট্রান্সেকশন ব্লক তৈরি করা হবে। বিটকয়েন ব্যবস্থার প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত এরকম সব গুলো ট্রান্সেকশন ব্লকের পরে নতুন ট্রান্সেকশন ব্লক তৈরি হবে। অনেকটা লেজার হালনাগাদের মত। তবে এখানে বলাই বাহুল্য, বিটকয়েনে ব্যবস্থার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব ট্রান্সেকশন তথ্য লিপিবদ্ধ থাকায় একজন চাইলেও দুই নম্বরি করতে পারবে না। যে ডাটা মাইনার ট্রান্সেকশন ব্লক তৈরি করবেন, তিনি রেওয়ার্ডতো পাবেনই, সাথে সাথে যত গুলো ট্রান্সেকশন হয়েছে তার সব গুলোর ফিও পাবেন। সব বৈধ ট্রান্সেকশন সম্পন্ন হবে।

ডাটা মাইনিং

ডাটা মাইনিং

২০০৯ সালে রেওয়ার্ড হিসেবে দেওয়া হত ৫০ বিট কয়েন। প্রতি চারবছর পর পর এই রেওয়ার্ডের পরিমাণ কমে অর্ধেক করা হয়। বর্তমানে এরকম একটা ট্রান্সেকশনের জন্য ২৫ বিটকয়েন দেওয়া হয়। এভাবে নতুন নতুন বিটকয়েন যোগ হচ্ছে। দেখা গেছে ১০ মিনিটের কম সময়ে একেকটা ট্রান্সেকশন ব্লক তৈরি হয়। ২১৪০ সালের পর ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন তৈরী হয়ে গেলে আর কোন নতুন বিটকয়েন তৈরী করা হবে না। বর্তমানে ১ বিটকয়েন সমান ২২০ ডলার। ভবিষ্যতে এর মূল্য আরো বাড়বে।

[important]চেস্টা ছিল মূল ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা। খুব সংক্ষেপে এবং সবার বোঝার উপযোগী করে আলোচনা করতে যেয়ে অনেক গাণিতিক এবং টেকনিক্যাল ব্যাপার বাদ দিয়েছি বা সহজ করে লিখেছি। বিটকয়েন প্রযুক্তিতে সুন্দর গাণিতিক ব্যবহার আছে। বর্গমূলের কারো কাছে হয়তো সেই ব্যাবহার গুলোর ব্যাখা পাব।[/important]


চাইনিজ বিটকয়েন মাইনারের কর্মযজ্ঞ

 

লিঙ্কঃ
বিটকয়েন অফিসিয়াল (বাংলাদেশ থেকে ব্যবহার করা যায় না )
বিটকয়েন নিয়ে বিস্তারিত
বিটকয়েনের গণিত
বিটকয়েন ভার্চুয়াল ওয়ালেট
বিটকয়েন ফ্যাক্ট নিয়ে একটী সুন্দর ইনফোগ্রাফিক

 

 

 

চন্দ্রশেখর
Author: চন্দ্রশেখর

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/chondro/3370/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

3 comments

  1. সুন্দর হয়েছে । অনেক কিছু জানলাম ।

  2. এইসব ব্যাপারগুলো কেন জানি আমার কাছে গোলোকধাঁধারমত মনে হয়। তোমার লেখাটা পড়ে বিটকয়েন সম্পর্কে জানতে পারলাম, খুবই ভালো লাগলো ।

  3. আমার নামের পরের অংশ থেকে কিছুই বুঝি নাই 😀 … পড়াশুনা করতে হবে একটু

মন্তব্য করুন