গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং

 

মহাবিশ্ববিজ্ঞান বা কসমোলজি হলো জ্যোতির্বিজ্ঞান এর সেই শাখা যা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর জন্ম দিয়েছে- এই মহাবিশ্ব কি দিয়ে গঠিত, কিভাবে গঠিত, এর বয়স কতো, এর ভবিষ্যৎ কি, কেনইবা মহাবিশ্ব এরকম।

সহস্রাব্দ ধরে মানুষ এই ধরণের প্রশ্ন করে আসছে কিন্তু কেবল মাত্র গত শতকে আমাদের শক্তিশালী টেলিস্কোপ, কম্পিউটিং দক্ষতা আর নিরলস গবেষণা আমাদেরকে এই প্রশ্নগুলোর গ্রহণযোগ্য উত্তরের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বর্তমান উপলব্ধি নিচের এই পাই চার্টটির মাধ্যমে এক নজরে প্রকাশ করা যেতে পারে।

Picture1

চিত্র ১- মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তি চার্ট

 

এই পাই চার্টটি সমগ্র মহাবিশ্বের সমস্ত ভর-শক্তিকে প্রকাশ করছে। ভর-শক্তির সাম্যতা দ্বারা বুঝায় যে আমরা এই দুটিকে সমান গণ্য করতে পারি। ভর কোনো বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তিকে প্রকাশ করে। যে সকল নিয়মিত ও স্বাভাবিক বস্তু বা পদার্থ দিয়ে এই সমগ্র মহাবিশ্ব অর্থাৎ ছায়াপথ, গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ধূলিকণা, শিলা, গ্যাস ইত্যাদি গঠিত তাদেরকে ব্যারিওনিক পদার্থ (baryonic matter) বলে। আর এই ব্যারিওনিক পদার্থ সমগ্র মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তির মাত্র ৪ শতাংশকে প্রকাশ করে। উপরের পাই চার্টটির বাকি দুটো অংশ হলো কৃষ্ণ বস্তু (dark matter) এবং কৃষ্ণ শক্তি (dark energy), আর এই তিনটিকে নিয়েই হলো আমাদের এখন পর্যন্ত জানা সমগ্র মহাবিশ্ব। কৃষ্ণ বস্তু এবং কৃষ্ণ শক্তির এইরকম নামকরণের কারণ হলো কস্মলোজিস্টরা এখনো জানেন না যে এইগুলো আসলে কি আর আমরাও এগুলোকে সরাসরি দেখতে পাই না। কেবল মাত্র আমাদের জ্ঞাত স্বাভাবিক পদার্থের উপর এইগুলোর দ্বারা সৃষ্ট প্রভাব দ্বারা আমরা এদের উপস্থিতি সনাক্ত করতে পারি। অদ্ভুতরকম ভাবে মহাবিশ্বের এক বিশাল অংশ আমাদের কাছে অদৃশ্য ও অজ্ঞাত হলেও এগুলোর সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া আমাদেরকে এদের অস্তিত্ব মেনে নিতে বাধ্য করেছে।

 

জ্যোতির্বিদরা যখন লেন্সিং নিয়ে কথা বলেন তখন তারা লেন্সিং বলতে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর প্রভাবকে বোঝান। সাধারণ লেন্স যেমন বিবর্ধক কাচ বা চশমা আলোকে বাঁকিয়ে প্রতিসরিত করে এবং একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে (যেমন আমাদের চোখ) সেই আলোকে ফোকাস করে। গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংও অনেকটা অনুরূপ পদ্ধতিতে কাজ করে। আইনস্টাইন এর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (General relativity) অনুসারে ভর আলোকে বাঁকাতে সক্ষম। খুব ভারী কোনো বস্তুর দ্বারা সৃষ্ট শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এর আশপাশ দিয়ে যাওয়া আলোকে বাঁকাতে পারে এবং তথাপি অন্য কোনো স্থানে ফোকাস করতে পারে। বস্তুর ভর যত বেশি হবে এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র ততটা শক্তিশালী হবে আর সেই ক্ষেত্র ততোটা বেশি করে আলোকে বাঁকাতে পারবে। অনেকটা অপটিক্যাল লেন্সের গঠনের মত, এর ভিতরে যত ঘন উপাদান ব্যবহার করা হবে এটি তত বেশি পরিমাণে আলোর প্রতিসরণ ঘটাবে।

Picture2

চিত্র ২

ছবির উৎস- NASA/ESA

 

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ছোট থেকে বড় সব মাত্রায়ই হয়। বিশাল বড় গ্যালাক্সি কিংবা গ্যালাক্সি ক্লাস্টার থেকে শুরু করে নক্ষত্র অথবা গ্রহের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও আলোকে লেন্স এর মত করে বাঁকাতে পারে। এমনকি আমাদের নিজেদের শরীর এর ভরও আমাদের কাছ দিয়ে যাওয়া আলোকে বাঁকাতে পারে, যদিও তার মাত্রা খুবই সামান্য বলে আমাদের কাছে তা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না।

এখন দেখা যাক গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া কিরূপ হতে পারে। কসমোলজিস্টরা মূলত বড় মাত্রায় সংঘটিত লেন্সিং নিয়ে বেশি আগ্রহী অর্থাৎ গ্যালাক্সি কিংবা গ্যালাক্সি ক্লাস্টার দ্বারা সৃষ্ট লেন্সিং নিয়েই তাদের কাজকারবার। টেলিস্কোপ এর সাহায্যে আমরা দূর মহাকাশের অসংখ্য গ্যালাক্সি দেখতে পাই। যদিও আমাদের পৃথিবী আর সেই গ্যালাক্সিপুঞ্জের মাঝে রয়েছে রহস্যময় কৃষ্ণবস্তু। কৃষ্ণবস্তু অদৃশ্য আর এর প্রকৃতি সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। তথাপি কৃষ্ণবস্তুর রয়েছে ভর। কৃষ্ণবস্তুর সম্মিলিত ভর সমগ্র মহাবিশ্বের মোট ভরের শতকরা ৮৫ ভাগ। তাই এটি থেকে বুঝাই যায় যে দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোকরশ্মি এই কৃষ্ণবস্তুর দ্বারা সৃষ্ট মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রর মাঝ দিয়ে আসবে আর সেই ক্ষেত্র আলোকে লেন্সের অনুরূপ বাঁকিয়ে দিবে।

 

মহাবিশ্বে যেখানে সাধারণ বস্তু (যা দ্বারা গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ইত্যাদি গঠিত) পাওয়া যায় সেখানেই রয়েছে কৃষ্ণবস্তুর উপস্থিতি। উদাহরণসরূপ বলা যায়, একটি বিশাল গ্যালাক্সি ক্লাস্টারে থাকবে বিশাল পরিমান কৃষ্ণবস্তু, এই কৃষ্ণবস্তু সেই ক্লাস্টার এর অভ্যন্তরে ও গ্যালাক্সি গুলোর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোকরশ্মি এই ক্লাস্টার এর পাশ দিয়ে আসার সময় এর বিপুল পরিমাণ ভর দ্বারা প্রভাবিত হবে অর্থাৎ সেই আলোর গতিপথ বিকৃত হবে যাকে আমরা বলছি লেন্সিং। কৃষ্ণবস্তুর ভর সাধারণ বস্তুর থেকে প্রায় ৬ গুন বেশি হবার কারণে আলোর এই লেন্সিং এর প্রায় পুরোটাই প্রভাবিত হবে এই কৃষ্ণবস্তুর দ্বারা। এই লেন্সিং এর প্রতিক্রিয়া একই সাথে শক্তিশালী এবং অদ্ভুত রকম হতে পারে। যেমন অনেক ক্ষেত্রে লেন্সিং এর কারণে দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোকরশ্মি সংকুচিত বা প্রসারিত হয়ে মূল গ্যালাক্সির দৃশ্যমান চেহারাই পরিবর্তন করে দিতে পারে। এরকম একটি উদাহরণের ছবি নিচে দেয়া হলো- এটি Abell 2218 গ্যালাক্সি ক্লাস্টার; এখানকার গ্যালাক্সি গুলো মূলত উপবৃত্তাকার বা সর্পিলাকার, কিন্তু শক্তিশালী লেন্সিং এর কারণে চেহারা এরকম হয়ে গিয়েছে।

Picture3

চিত্র ৩- Abell 2218 ক্লাস্টার

ছবির উৎস- NASA/ESA

 

এই ধরণের অদ্ভুত আকার বিকৃতির কারণ হলো বিশালাকার গ্যালাক্সির একপাশ যেমন বাম পাশ থেকে আগত আলোকরশ্মি এবং ডানপাশ থেকে আগত আলোকরশ্মি মহাশুন্যে দুটি ভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে আসে। আর তাই এই দুই পাশের দুই আলোকরশ্মি ভিন্ন ভিন্ন কৃষ্ণবস্তুর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের দ্বারা পৃথক পৃথক ভাবে প্রভাবিত হয় আর তাদের বেঁকে যাওয়ার প্রকৃতিও হয় তাই ভিন্নরকম। ফলাফলসরূপ তাই মূল গ্যালাক্সির প্রকৃত চেহারাই পরিবর্তন হয়ে এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এই পরিবর্তন কখনো প্রকট আকারও ধারণ করে।

লেন্সিং এর আরও একটি আকর্ষণীয় ও কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো একই গ্যালাক্সির একাধিক ইমেজ বা প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হওয়া। এর কারণ হলো অনেক দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোকরশ্মি যা অপসৃত (diverge) হবার কথা ছিল তা লেন্সিং এর প্রভাবে অভিসারী (focus) হয়ে আমাদের কাছে ধরা পড়ে। পৃথিবীতে অবস্থাকারী কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে তখন মনে হবে যে দুটি একই রকমের সোজা আলোকরশ্মি মহাকাশের দুটি ভিন্ন অংশ থেকে আসছে। এই বিষয়টির একটি ছবি উপরে দেয়া হয়েছে (চিত্র ২), যেখানে কমলা রঙের রেখা দুটো একই গ্যালাক্সি থেকে আগত দুটি পৃথক আলোকরশ্মির প্রতিনিধিত্ব করছে যা পৃথিবীতে আমাদের চোখে পড়লে মনে হবে যেন এই আলোকরশ্মি দুটো ভিন্ন গ্যালাক্সি থেকে আসছে। লেন্সিং এর এরকম প্রভাবে আমরা অনেক সময় মহাকাশে একই গ্যালাক্সির একাধিক ইমেজ দেখতে পাই। লেন্সিং অনেক সময় বিবর্ধক কাচ (magnifying glass) এর মতও কাজ করতে পরতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অতি দূর গ্যালাক্সির দূর্বল আলো লেন্সিং এর কারণে বিবর্ধিত হয়ে আমাদের টেলিস্কোপে ধরা পড়ে। লেন্সিং না থাকলে হয়তো আমরা সেই গ্যালাক্সি গুলোর অস্তিত্ব খুঁজেই পেতাম না

 

নিচের ছবিতে এরকম একটি উদাহরণ দেয়া হল (চিত্র ৪)। হাবল স্পেস টেলিস্কোপে ধারণ করা এই ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটি গ্যালাক্সির তিনটি প্রতিবিম্ব বা ইমেজ এবং একটি কোয়াসার গ্যালাক্সির (quasar) পাঁচটি ইমেজ। এই ইমেজগুলো কিন্তু একই আকার কিংবা আকৃতির নয়। কারণ এই প্রত্যেকটি ইমেজ আমাদের কাছে পৌঁছাবার আগে যাত্রাপথে ভিন্ন ভিন্ন  অঞ্চল বা স্পেসের মধ্য দিয়ে এসেছে, এবং তাই প্রত্যেকটি ইমেজই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিকৃত হয়েছে। একই গ্যালাক্সির ভিন্ন ভিন্ন ইমেজ সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহার করা হয় স্পেকট্রোস্কপি (spectroscopy) নামক বিশেষ এক প্রযুক্তির।

Picture4

চিত্র ৪

ছবির উৎস- NASA/ESA

 

দুর্বল লেন্সিং (weak lensing)

লেন্সিং প্রভাব যদি খুব শক্তিশালী হয় যা মানুষ খুব সহজেই কোন এস্ট্রোনমিক্যাল ইমেজে ( যেমন Abell 2218 এর ছবি) সনাক্ত করতে পারে তবে তাকে বলা দৃঢ় বা শক্তিশালী লেন্সিং। টার্গেট গ্যালাক্সি এবং আমদের মাঝে যদি আলোর যাত্রাপথে খুব বড় ভরের গ্যালাক্সি ক্লাস্টার থাকে তবেই সেই টার্গেট গ্যালাক্সির প্রতিকৃতির উপর শক্তিশালী লেন্সিং কাজ করবে। এই কারণে খুব দূরবর্তী গ্যালাক্সির আকৃতিগুলোই সাধারণত শক্তিশালী লেন্সিং দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। আর এই কারণে এই সব ক্ষেত্রে লেন্সিং এর প্রভাব সনাক্ত ও পরিমাপ করা সহজ। কিন্তু এরকম বড় মাপের লেন্সিং ইফেক্ট তৈরি করতে সক্ষম বিশাল ভরের গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের সংখ্যা মহাকাশে খুবি কম। আর তাই আমরা মহাকশে একই গ্যালাক্সির ধনুকের মতো প্রসারিত ছবি অথবা একাধিক প্রতিচিত্রের মতো ঘটনা খুব অহরহ দেখতে পাই না। অন্যকথায় বলতে গেলে মহাকশে শক্তিশালী লেন্সিং এর ঘটনা বেশ দুর্লভ।

কিন্তু যেকোনো গ্যালাক্সি এবং আমদের মাঝে দৃষ্টিপথে রয়েছে কৃষ্ণবস্তুর উপস্থিতি। তাই মাত্রা যতই সামান্য বা ক্ষীণ হোক না কেন, আমরা যত ধরনের গ্যালাক্সি দেখতে পাই তাঁর সবগুলোই লেন্সিং দ্বারা প্রভাবিত। গাণিতিক ভাবে বলতে গেলে প্রায় সব গ্যালাক্সির আকৃতিই লেন্সিং এর কারণে মোটামুটি শতকরা ১ ভাগ বিকৃত হয়। এই ধরণের ক্ষীণ লেন্সিং এর ঘটনাকে আমরা বলি দুর্বল লেন্সিং।

 

দুর্বল লেন্সিং এর কারণে সৃষ্ট এই ধরণের ক্ষুদ্র আকার বিকৃতি আমরা আমাদের খালি চোখের সাহায্যে ধরতে পারবো না। কিন্তু বিভিন্ন ধরণের কৌশল অবলম্বন করে বিজ্ঞানীরা এই ধরণের লেন্সিং এর উপস্থিতি সনাক্ত করেছেন। দুর্বল লেন্সিং আমাদেরকে মহাকশে কৃষ্ণ বস্তুর উপস্থিতি এবং এর আচরণ  ও ভূমিকা বুঝতে সহায়তা করছে।

লেন্সিং এর মাত্রা পরিমাপ করবার কিছু পদ্ধতি রয়েছে। এর জন্য প্রতিটা গ্যালাক্সির চিত্রের উপর আলাদাভাবে লেন্সিং এর মাত্রা হিসাব করবার কোন দরকার নেই। বরং আমরা এক সেট গ্যালাক্সির উপর লেন্সিং এর গড় হিসাব করতে পারি। এর জন্য মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ বা কসমোলজিস্টরা দুটি পূর্বানুমান (assumption) ধরে নেয়। প্রথমত, সব গ্যালাক্সির সামগ্রিক আকৃতি মোটামুটি ভাবে উপবৃত্তাকার। আর দ্বিতীয়ত গ্যালাক্সিগুলো মহাকাশে এলোমেলো বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। নিচের ছবিটি দেখুন (চিত্র ৫)। লেন্সিং ইফেক্ট এর উপস্থিতির কারণে আমরা আশা করতে পারি যে মহাকাশের কোন একটা অংশের গ্যালাক্সিগুলো নিজেদেরকে কিছুটা একসাথে জোটবদ্ধ করবে। কারণ লেন্সিং মহাকাশের ওই অংশের সবগুলো গ্যালাক্সির ছবিকে একই দিকে প্রসারিত করবে। এভাবে মহাকশের কোন একটা অংশের বিচ্ছিন্ন গ্যালাক্সিগুলোর অবস্থান ও আকারের বিচ্যুতি আমাদেরকে মহাকাশের সেই অংশের লেন্সিং মাত্রা সম্পর্কে একটি সরাসরি ধারণা ও হিসাব দেয়। দুর্বল লেন্সিং এর মাধ্যমে তাই আমরা আকাশের যেকোনো অংশে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর মাত্রা পরিমাপ করতে পারি।

Picture5

চিত্র ৫

 

লেন্সিং কেন দরকারি?

কসমোলজিস্টদের কাছে লেন্সিং খুবই দরকারি। কারণ এটি সরাসরি তাদেরকে মহাকশে কৃষ্ণবস্তুর উপস্থিতি, পরিমাণ, বিন্যাস ও প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দেয়। যাত্রাপথে আলোর বাঁক নেয়া পুরোপুরি নির্ভর করে এর পথে বিদ্যমান মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তীব্রতার উপর। আর এই মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের উৎপত্তি হয় মহাকাশে কৃষ্ণবস্তুর উপস্থিতির কারণে। অর্থাৎ আকাশের কোন একটা অংশে লেন্সিং এর মাত্রা বুঝার জন্য আমাদেরকে সেই পর্যবেক্ষমান টার্গেট গ্যালাক্সির গঠন, প্রকৃতি, আচরণ কিংবা বিচ্ছুরত আলোর প্রকৃতি সম্পর্কে জানবার কোন প্রয়োজন নেই। গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং যেহেতু অল্প কিছু অনুমান ও বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, তাই এটিকে খুবি পরিষ্কার এবং বিশ্বাসযোগ্য একটি মহাজাগতিক ঘটনার প্রমাণ বলা চলে।

 

লেন্সিং তাই বিজ্ঞানীদেরকে মহাকাশে মোটের উপর বিদ্যমান কৃষ্ণবস্তুর পরিমাণ এবং বিন্যাস-বণ্টন পরিমাপ করতে সাহায্য করেছে (যেমনটা আমরা ইতিপূর্বে পাই চার্টটিতে দেখেছি)।  CFHTLenS ডেটা থেকে সংগৃহীত কৃষ্ণবস্তুর ম্যাপ বা মানচিত্রের একটি ছবি (চিত্র ৬) নিচে দেয়া হল-

Picture6

চিত্র ৬- CFHTLenS ডেটা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ছবি

 

কৃষ্ণবস্তুর অস্তিত্ব নির্ণয়ে তাই লেন্সিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিচের ছবিটি বুলেট ক্লাস্টার (Bullet Cluster) নামে পরিচিত (চিত্র ৭)। এই ক্লাস্টারটি দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ এবং এক্স রে তরঙ্গ দিয়ে দুই মাধ্যমেই পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এই ক্লাস্টার থেকে আগত আলোর একটা বড় অংশ আসে উত্তপ্ত এক্স রে বিকিরণকারী গ্যাস থেকে। আর ছবিতে দেখানো গোলাপি অংশটুকু হল দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গে দেখা অংশ। মূলত এই ছবিটি এক্স রে এবং দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গে দেখা অংশগুলার একটা ওভারলে বা কম্পোজিট চিত্র। আর ছবির নীল অংশটুকু ক্লাস্টারে কৃষ্ণ বস্তুর উপস্থিতিকে নির্দেশ করছে। দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা ছবিতে লেন্সিং সিগন্যাল হিসাব করে এই অবস্থান সনাক্ত করা হয়েছে। এই ছবির গোলাপি এক্স রে গ্যাস এবং নীল কৃষ্ণবস্তুর অঞ্চলের পার্থক্য (offset) প্রকৃতপক্ষে দুটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের মধ্যকার সংঘটিত সংঘর্ষের পরবর্তী অবস্থাকে নির্দেশ করছে। এই সংঘর্ষের সময়, বারিওনিক (নিউক্লিওন বা হাইপেরন এর মতো অতি পারমাণবিক কণিকা, যেগুলোর ভর প্রোটনের সমান বা কিছুটা বেশি) এক্স রে গ্যাস কণিকা গুলো (সাধারণ বস্তু) একে ওপরের সাথে মহাকর্ষ এবং স্থিরতড়িৎ বল, উভয় ক্ষেত্রের মধ্য দিয়েই ইন্টারেক্ট করেছে, একে অপরকে ধাক্কা দিয়েছে এবং ধীর গতির করেছে। কিন্তু কৃষ্ণবস্তুর কণিকা গুলো একে ওপরের সাথে কেবল মাত্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্য দিয়েই ইন্টারেক্ট করেছে। তাদের এই মিথষ্ক্রিয়ায় স্থিরতড়িৎ বলের ক্ষেত্র কোন প্রভাব বা ভূমিকা রাখেনি। আর তাই এই সংঘর্ষে এক্স রে গ্যাস কণিকা গুলো কৃষ্ণবস্তুর তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে এবং ছবিতে এই পার্থক্যের (offset) সৃষ্টি করেছে। দৃশ্যমান বস্তুর প্রায় পুরোটাই মোটামুটি ভাবে ছবির কেন্দ্রে অবস্থান করছে। কিন্তু লেন্সিং ইফেক্ট থেকে আমরা বলতে পারি এই ক্লাস্টারের ভরের বেশিরভাগ অংশই আরও বড় অঞ্চল নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে।

Picture7

চিত্র ৭- বুলেট ক্লাস্টারেরকম্পোজিট চিত্র

ছবির উৎস- NASA/STScI

 

যেহেতু এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা কৃষ্ণবস্তুর প্রভাবগুলোর সবগুলোই মহাকর্ষ সম্পর্কিত, তাই অনেক বিজ্ঞানীদের ধারণা মহাকর্ষ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা ধারণা এখনো সম্পূর্ণ নয়। হয়তোবা এমন হতে পারে যে কৃষ্ণবস্তু কোন নতুন ধরণের বস্তু নয়, বরং মহাকর্ষ সম্পর্কে আমাদের বর্তমান ধারণায় কোন ধরণের ত্রুটি রয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে কৃষ্ণবস্তুর ঘটনাকে ব্যাখ্যা করবার জন্য মহাকর্ষ তত্ত্বের অনেকগুলো পরিবর্তিত সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে। বুলেট ক্লাস্টারের ছবিটি কৃষ্ণবস্তুর উপস্থিতির একটি শক্ত প্রমাণ। কৃষ্ণবস্তুর অস্তিত্ব থাকলে আলো এবং ভরের আচরণ যেমন হতো বলে বিজ্ঞানীরা আশা করেছেন, ছবির এই অফসেটটি ঠিক তাই প্রকাশ করে। কৃষ্ণবস্তুর এই অবস্থানের পক্ষে প্রমাণ থাকলেও বর্তমান মহাকর্ষ তত্ত্ব বা এর বিভিন্ন পরিবর্তিত বা পরিমার্জিত সংস্করণ দিয়েও এর উপস্থিতির ব্যাখ্যা দেয়া বেশ কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

আমরা যদি টেলিস্কোপর সাহায্যে দেখা কোন গ্যালাক্সির দূরত্ব হিসাব করতে পারি তবে লেন্সিং আমাদেরকে কৃষ্ণশক্তির (dark energy) প্রকৃতি সম্পর্কেও অনেক ধারণা দেয়। কৃষ্ণশক্তির উপস্থিতি গ্যালাক্সি এবং ক্লাস্টার এর সৃষ্টি, গঠন এবং সম্প্রসারণে প্রভাব ফেলে। মহাকাশে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর সাহায্যে নির্ণয় করা তাদের দূরত্ব এবং বণ্টন পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা প্রায় নিখুঁত ভাবে কৃষ্ণশক্তির পরিমাণ নির্ণয় করেছেন। দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আসন্ন আলো আমাদের দিকে যাত্রা শুরু করেছে অনেক অনেক মিলিয়ন বছর আগের থেকেই। আর এই আলো আমাদেরকে সামনে উন্মোচন করেছে আদি মহাবিশ্বের স্বরূপটিকে। বিভিন্ন দূরত্বে গ্যালাক্সির গঠন ও অবস্থানগত পার্থক্য থেকে মহাবিশ্বে কৃষ্ণশক্তির পরিমাণের পরিবর্তন (হ্রাস-বৃদ্ধি বা অপরিবর্তনশীলটা) সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব। গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং তাই কৃষ্ণবস্তু এবং কৃষ্ণশক্তিসহ মহাবিশ্বের প্রকৃতরূপ উদ্ঘাটনের জন্য খুবি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

 

এবার দেখা যাক গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এবং অপটিকাল লেন্সিং এর মধ্যে পার্থক্য কি। অপটিকাল লেন্সিং এবং গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর মধ্যে পার্থক্যের মূল জায়গাটা হল, গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই  সমানভাবে বাঁকিয়ে দেয়। কারণ মহাকর্ষ সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর উপরই সমান প্রভাব বিস্তার করে। অপরদিকে অপটিকাল লেন্সিং বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে বিভিন্ন ভাবে বাঁকিয়ে দেয় (পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় diffraction বা বিচ্ছুরণ)। উদাহরণস্বরূপ আমরা রংধনুর কথা ভাবতে পারি। গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর সাথে তাই অপটিকাল লেন্সিং এর তেমন কোন সাদৃশ্য নেই।

 

 

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

আইন্সটাইন সর্বপ্রথম তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সূর্যের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের জন্য আলোর পথবিচ্ছুতির সম্ভাব্যতার কথা উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে ইংরেজ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন (১৮৮২ – ১৯৪৪) পরীক্ষার সাহায্যে এর সত্যতা নিরূপণ করেন (আগ্রহী পাঠকেরা চাইলে এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানবার জন্য ২০০৮ সালে বিবিসির নির্মিত Einstein and Eddington টেলিভিশন মুভিটি দেখতে পারেন)। কিন্তু আইন্সটাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রস্তাবনার আগেই আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন আলোর পথবিচ্ছুতি নিয়ে, যেখানে প্রথম গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং সম্পর্কিত বিষয়াদির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

দূরবর্তী আলোক উৎস থেকে আগত আলোকরশ্মি এর যাত্রাপথে কোন ভারি বস্তুর মহাকর্ষ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হলে তখন সেই আলোক রশ্মি দুটি ভিন্ন পথে পর্যবেক্ষকের নিকট পৌঁছাতে পারে (চিত্র ৮)। যেমনটা দেখানো হয়েছে নিচের চিত্রে- দূরবর্তী উৎস S থেকে আগত আলো এর যাত্রা পথে M বস্তুর মহাকর্ষ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দুটি ভিন্ন পথে পর্যবেক্ষক O এর নিকট পৌঁছায়। ফলে পর্যবেক্ষক O একই বস্তু S এর দুটি ভিন্ন ছবি দেখতে পায়।

Picture8

চিত্র ৮

 

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সম্ভাবনার কথা আইন্সটাইন প্রথম তাঁর নোটবুকে উল্লেখ করেন ১৯১২ সালে। সে সময় তিনি বার্লিনে জ্যোতির্বিদ আরউইন ফ্রেনড্লিক (Erwin Freundlich, ১৮৮৫-১৯৬৪) এর সাথে এই ধারণার পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়ে বেশ আলোচনা করেন। আইন্সটাইন তাঁর নোটবুকে লেন্সিং নিয়ে কিছু প্রাথমিক ধারণা এবং ফরমুলা প্রকাশ করেন। তাঁর নোটবুকের লেখার একটি ছবি (চিত্র ৯) নিচে দেয়া হল-

Picture9

চিত্র ৯- আইন্সটাইনের নোটবুকে তাঁর হাতের লেখা

 

তবে আইন্সটাইন নিজেই এরকম লেন্সিং ক্রিয়া পর্যবেক্ষণের সম্ভাব্যতা নিয়ে বেশ সন্দিহান ছিলেন। কারণ লেন্সিং ইফেক্ট নির্ভর করে আলোক উৎস, মহাকর্ষ ক্ষেত্র তৈরিকারী বস্তুর ভরের তীব্রতা এবং এদের সাথে পর্যবেক্ষকের দূরত্বের উপর। তাই এরকম একটি ঘটনা অর্থাৎ একই বস্তুর দুটি প্রতিচিত্র দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আশা করাটা ছিল বেশ কঠিন এবং উচ্চভিলাসি।

পরবর্তীকালে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং সংক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত্বের উন্মোচন হতে থাকে বিজ্ঞানী মহলে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রকাশনাগুলোতে। আইন্সটাইন নিজেও ১৫ই ডিসেম্বর ১৯১৫ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, তাঁর বন্ধু হাইনরিখ জাঙগার (Heinrich Zangger, ১৮৭৪-১৯৫৭) এর নিকট এ বিষয়ের বিস্তারিত নিয়ে একটা চিঠি লিখেন। এই চিঠিটি পরবর্তীকালে অলিভার লজ (Oliver Lodge, ১৮৫১-১৯৪০) সম্পাদনা করে নেচার সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। এছাড়াও এডিংটন তাঁর ১৯২০ সালে প্রকাশিত Space, Time and Gravitation নামক গ্রন্থে এবং স্বনামধন্য জার্নাল Astronomische Nachrichten এ  গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন। যদিও সে সময় সব বিজ্ঞানীরাই প্রাথমিক ভাবে ধারণা করেছিলেন যে ভূমিতে বসে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর প্রভাব প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়।

 

পরবর্তীকালে ১৯৩৬ সালে আইন্সটাইনের আমেরিকার প্রিন্সটনে বসবাসকালীন সময়ে একজন চেক ইঞ্জিনিয়ার, রুডি ম্যান্ডল (Rudi W. Mandl) তাঁর সাথে দেখা করেন এবং গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর উপর বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি ধারণা করেন শক্তিশালী নক্ষত্রের আলোর দ্বারা সৃষ্ট লেন্সিং ক্রিয়া হয়তোবা পৃথিবীতে জৈববৈজ্ঞানিক বিবর্তন এবং জেনেটিক মিউটেশনের সূচনা করেছিলো। কিন্তু ততদিনে আইন্সটাইন নিজেই তাঁর লেন্সিং নিয়ে গবেষণা কাজকারবার সম্পর্কে বেমালুম ভুলে বসছিলেন এবং অন্যদের গবেষণা সম্পর্কেও তাঁর কোন ধারণা ছিল না। পরে ম্যান্ডলের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে আইন্সটাইন আবারও সায়েন্স সাময়িকীতে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই গবেষণাপত্রে আইন্সটাইন গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর অপটিকাল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু ফরমুলা প্রকাশ করেন। নিচে এর একটি ছবি দেয়া হল-

Picture10

চিত্র ১০- সায়েন্স (১৯৩৬, পৃষ্ঠা ৫০৬) সাময়িকীতে প্রকাশিত আইন্সটাইনের গবেষণা প্রবন্ধ

 

এই পত্রটি প্রকাশের পড় আরও অনেক জ্যোতির্বিদ এর উপর আরও বিস্তারিতভাবে কাজ করবার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ Fritz Zwicky প্রস্তাব করেন যে নক্ষত্রের তুলনায় দূরবর্তী নেবুলা এবং গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে লেন্সিং ইফেক্ট তথা একই বস্তুর দুটি প্রতিচিত্র পর্যবেক্ষণ করা বেশি সহজ হবে। কারণ বড় গ্যালাক্সির আকার, ভর, দূরত্ব সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো আরও বেশি করে লেন্সিং ক্রিয়া ঘটাবে, যেটা কেবল নক্ষত্রের বেলায় ঘটার সম্ভাবনা অনেক ক্ষীণ।

 

গত শতকের ষাট এর দশকে কোয়াসারের আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের নতুন করে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর পর্যবেক্ষণমূলক পরীক্ষায় আগ্রহী করে তুলে। ততদিনে লেন্সিং সংক্রান্ত গবেষণা এবং হিসাব নিকাশ গুলো আরও অনেক জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তত্ত্বীয় ভাবে বিন্দু উৎস থেকে নির্গত আলোকরশ্মি সুসম সর্পিলাকার লেন্স ভরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হলে এর গণনা অনেক সহজ। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আলোক উৎস এবং লেন্স ভর কোনটাই সুশম নয় বরং আকারে বিশাল এবং আকৃতিতে অনিয়মিত। এবং হয়তোবা একটি বস্তুর একাধিক বিছিন্ন আকৃতির প্রতিচিত্র সৃষ্টিও অসম্ভব নয়।  আইন্সটাইনের মূল তত্ত্ব অনুসারে এসব ঘটনার ব্যাখ্যা এবং নিরীক্ষা বেশ কঠিন ব্যাপার। তাই সাধারণ আপেক্ষিকতার আরও কিছু জটিল মডেল তৈরি করা হয় এধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য।

সর্বপ্রথম গ্র্যাভিটেশনাল লেন্স খুঁজে বের করেন Dennis Walsh, Robert F. Carswell এবং Ray J. Weymann ১৯৭৯ সালে। রেডিও তরঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা Quasar Q0957+561 এর দুটি ভিন্ন প্রতিচিত্র খুঁজে বের করেন যা লেন্সিং এর একটি উৎকৃষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। নিচে দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গে পুননির্মিত এর একটি ছবি (false color image) দেয়া হল–

Picture11

চিত্র ১১- Quasar Q0957+561

 

নিচে কোয়াসার QSO 2237+0305 এর একটি ছবি দেয়া হল। এই লেন্সিং সিস্টেমটি আইন্সটাইন ক্রস নামে পরিচিত এবং আবিষ্কার হয় ১৯৮৫ সালে।

Picture12

চিত্র ১২- আইন্সটাইন ক্রস

 

এরকম আরও একটি উদাহরণ হল MG1131+0456, যা আইন্সটাইন রিং নামে পরিচিত। এটি আবিষ্কার হয় ১৯৮৮ সালে।

Picture13

চিত্র ১৩- আইন্সটাইন রিং

 

২০০৫ সাল পর্যন্ত অ্যারিজোনা স্পেস অবজারভেটোরি ৬৪ টি নিশ্চিত লেন্সিং সিস্টেম আবিষ্কার করেছে যেগুলার প্রতিটারই একাধিক প্রতিচিত্র রয়েছে। এবং আরও ১৮ টি সম্ভাব্য লেন্সিং সিস্টেম এর খোঁজ পেয়েছে।

বর্তমানকালের জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা গবেষণায় লেন্সিং একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ১৯৮৩ সালে ফ্রান্সের Liège প্রথম গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবছরই অনুরূপ বৈজ্ঞানিক সম্মেলন হচ্ছে। লেন্সিং এখন আর কোন তত্ত্বীয় বিষয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই বরং এটি এখন ব্যবহার হচ্ছে মহাবিশ্বতত্ত্ব এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের বাস্তব ও প্রায়োগিক গবেষণায়। এটি এখন মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, কৃষ্ণবস্তু, বিগব্যাং মডেল ইত্যাদি গবেষণার একটি শক্তিশালী টুল বা হাতিয়ার।

 

[এই লেখাটি জিরো টু ইনফিনিটির জুন ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে]

MD. Tariqul Islam

Elephant Road, Dhaka, BD

Facebook    |    Twitter

Tariqul Dipu
Author: Tariqul Dipu

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/tariquldipu/4158/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

2 comments

  1. লেন্সিং নিয়ে অনেক কিছু জানলাম।

  2. সুন্দর লেখা । আমার একটা প্রশ্ন আছে – আমরা খালি চোখে আকাশে যেসব তারা/নক্ষত্র দেখছি, সেই দেখায় কী Gravitational Lens এর কোন প্রভাব আছে ? একই নক্ষত্রের ভিন্ন ভিন্ন বিম্ব কী খালি চোখে ধরা পরা সম্ভব ? বা অন্যভাবে ঘুরিয়ে বললে আমরা খালি চোখে যা দেখছি তার মাঝে বিভ্রমের সম্ভাবনা কতটুকু ?

মন্তব্য করুন