শিল্পকলায় গণিত

17-gonsগণিত মানেই কি কেবল ভারী চশমা পরা গুরুগম্ভীর মানুষের জটিল হিসাব নিকাশের বিষয়? নাকি এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে শিল্পকলারও? প্রথম বিবেচনায় মনে হতে পারে গণিত এবং শিল্পকলা দুইটা দুই মেরুর বিষয়। গণিতের কাজ হিসাব, যুক্তি আর প্রমাণ নিয়ে যেখানে শিল্পকলা হলো আবেগ, অনুভূতি, সৃজনশীলতা আর নান্দনিকতার বাহার। কিন্তু এই দুটো বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক আমাদের অনুমানের থেকেও গভীর। এই লেখাটিতে আমি চেষ্টা করব শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে গণিতের ব্যবহারিক প্রয়োগ কিংবা পৃথিবীর বিভিন্ন সৃষ্টিশীল মানুষের দ্বারা তাদের শৈল্পিক কর্মে গণিতের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস সম্পর্কে আলোচনা করতে।

 গান শুনতে কিংবা ছবি আঁকতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুব কমই আছে।  কিন্তু সেই তুলনায় গণিত পছন্দ করে এরকম মানুষ আবার হাতে গোনা। বরং বেশিরভাগ মানুষই গণিত থেকে যথা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। তাহলে কিভাবে গণিতের মতো (বেশিরভাগ মানুষের কাছে) অপ্রিয় আর ভীতিকর একটি বিষয় শিল্পকলার মতো সর্বজনগ্রাহ্য এবং সর্বজনবিদিত কোনো কিছুর সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে? একটু গভীরে তাকালেই আমরা এ দুটো বিষয়ের মধ্যে সূক্ষ  সম্পর্কটা ধরতে পারবো। মহাবিশ্বের সবকিছু ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে সুন্দর ভাষা হলো হলো গণিত। আর শিল্পকলা যদি হয় প্রকৃতি আর আমাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করার সবচেয়ে সৃজনশীল মাধ্যম তবে গণিত এবং শিল্পকলা তো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হতেই হবে।

 

 সঙ্গীতে গণিত

সঙ্গীতে গণিতের অবদান নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিত ভাবেই সবার আগে চলে আসে পিথাগোরাস এর নাম। পিথাগোরাস এর সময় গ্রিকরা সঙ্গীতকে সৃজনশীল কোন কিছুর থেকে বরং গাণিতিক কোনো কিছু মনে করতেই বেশি পছন্দ করতো। এবং তৎকালীন সময়ে তাদের জ্ঞান এর ধারা আবর্তিত হতো পাটিগণিত, জ্যামিতি, সঙ্গীত এবং জ্যোতির্বিদ্যা এই চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে।  সঙ্গীতকে তারা শব্দ এবং ঐকতান(harmony) এর বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করতো। শব্দের বিভিন্ন সমন্নয় বিভিন্ন ধরনের শ্রুতিমধুর কিংবা শ্রুতিকটু আওয়াজ তৈরী করে এটা অনেক আগে থেকেই জানা থাকলেও পিথাগোরাস এর গবেষণা সর্বপ্রথম এই বিষয়টির গাণিতিক ভিত্তি পরিস্কার করেন। তিনি সুরসংগতি(consonance) ও সুরঅসংগতি(dissonance) অথবা বেসুরো সুরের গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন।Pythagorus তিনি পিচ (pitch) এবং অকটেভ(octave) নিয়ে কাজ করেন।  যেমন পিয়ানোর প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত C নোট ২৬২ হার্জ কম্পাঙ্কে শব্দ উৎপন্ন করে অর্থাৎ যেকোনো কিছু যদি এই কম্পাঙ্কে শব্দ তরঙ্গ তৈরী করে তবে তা C নোট এর মত আওয়াজ দিবে। এখন কোনো নোট এর সাথে যদি আরো একটি নোট মিলে ১:২ অনুপাতে একই শব্দ উৎপন্ন করে (কিন্তু ভিন্ন পিচ এ) তাহলে সেই দুটি নোট মিলে একটি অকটেভ তৈরী করবে। পাশ্চাত্যের সঙ্গীত স্কেল (C, D, E, F, G, A, B) অনুযায়ী একই  অনুপাতের কম্পাঙ্কের সকল নোট গুলোকে একই নামে ডাকা হয়। এভাবে যেসব কম্পাঙ্কের নোট গুলো মিলে একই শব্দ তৈরী করে তাদেরকে ঐক্যতানিক সুর (consonant chords) বা শ্রুতিমধুর সুর বলে।  তাই যদি ১:২, ২:৩, ৩:৪, ৪:৫ অথবা C ও C, C ও G, C ও F এবং C ও E এই নোটগুলো একত্রে বাজানো হয় তবে তারা ঐক্যতানিক সুর তৈরী করবে। আবার যদি C ও D একত্রে বাজানো হয় তবে তারা বেসুরো (dissonant chord) শব্দ তৈরী করবে। আরো মজার ব্যাপার হলো এই অনুপাত গুলোর সাথে যে শুধু কম্পাঙ্কেরই সম্পর্ক রয়েছে তা নয় বরং পিয়ানোর প্রতিটা ‘কি'(key) এর সাথে যে স্ট্রিং বা সুতো থাকে তার দৈর্ঘ্যের সাথেও এই অনুপাত গুলোর সম্পর্ক রয়েছে। উদাহরণসরূপ পিয়ানোর C ‘কি’ এর স্ট্রিং এর দৈর্ঘ্য যতটুকু, তা পরিবর্তন করে  যদি এর দৈর্ঘ্যের চার-পঞ্চমাংশে আনা হয় তবে সেই ‘কি’ টি E এর মত নোট তৈরী করবে। Piano_Note_Chart

 

 সোনালী অনুপাত (The Golden Ratio)

WXPoAumসোনালী অনুপাত নিয়ে মানুষের আগ্রহ অনেকটা সভ্যতার একেবারে গোড়ার দিক থেকেই। সর্বপ্রথম এই বিষয়টিকে লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসেন পিথাগোরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দিতে। অতঃপর ইউক্লিড এবং অ্যারিস্টটল এর দ্বারা এর নান্দনিক আর ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট গুলো আরও ভালোভাবে প্রকাশ পায়। সোনালী অনুপাতের মান ১.৬১৮। বারো শতকের গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চির ‘ফিবোনাচ্চি ধারা’ এর দ্বারা এই অনুপাতের আরো কিছু বৈশিষ্ট প্রকাশ পায় এবং প্রকৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরো সুস্পষ্ট হয়।  ফিবোনাচ্চি ধারার প্রথম দুইটি সংখ্যা হলো ১ এবং ১।  এই ধারার পরবর্তী প্রতিটা সংখ্যা হলো এর আগের দুইটি সংখ্যার যোগফলের সমান। সুতরাং তাহলে ধারাটি দাড়ায় ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩……………. অন্য দিকে সোনালী অনুপাতের মান φ=(১+√৫)/২≈ ১.৬১৮০৩৩৯৯। ফিবোনাচ্চি ধারার পরপর যেকোন দুইটা সংখ্যার অনুপাতের মানও হয় এই সোনালী অনুপাতের সমান। জ্যামিতিক ভাবে ব্যাখ্যা দিতে গেলে বলতে হয় একটি লাইনকে দুই ভাগে বিভক্ত (golden section) করে পুরো লাইন এর দৈর্ঘ্য ও লাইনের বড় অংশের দৈর্ঘ্যের অনুপাত ওই লাইনের বিভক্ত দুই অংশের অনুপাতের সমান, যা হলো সোনালী অনুপাত। প্রকৃতির বিভিন্ন প্যাটার্নেও এই অনুপাতের উপস্থিতি লক্ষ্য যায়।  বিভিন্ন জ্যামিতিক কাঠামো যেমন একটি পেন্টাগনের যেকোন একপাশের দৈর্ঘ্য আর এর কর্ণের অনুপাতও এই সোনালী অনুপাত। Fibonacciএছাড়া প্রকৃতিতে বিদ্যমান বিভিন্ন বস্তু যেমন ফুলের গঠন কিংবা শামুকের খোলস এর ভিতরেও এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আর এর ব্যবহার রয়েছে সঙ্গীতেও। অনেক মিউজিসিয়ানরাই তাদের কম্পোজিশন এই অনুপাত আর ফিবোনাচ্চি ধারা ব্যবহার করেছেন। এর ব্যবহার রয়েছে বাদ্যযন্ত্রেও। যেমন পিয়ানোতে একটি অকটেভ এর সাথে ৮টি সাদা আর ৫টি কালো নোট (মোট ১৩টি) থাকে, এর মধ্যে কালো নোটগুলো আবার ২ এবং ৩টি  করে ভাগ করা থাকে। আর এই সব গুলো সংখ্যাই হলো ফিবোনাচ্চি ধারার এক একটি উপাদান। এছাড়াও আরো অনেক বাদ্যযন্ত্র যেমন ভায়োলিন বানানোর সময় এই অনুপাত বজায় রাখা হয়। তবে সঙ্গীতের সাথে গণিতের সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন সম্ভবত উলফগ্যাং মোজার্ট (Wolfgang Amadeus Mozart). সঙ্গীতে তার অবদান বলাই বাহুল্য আর তিনি গণিতেরও একজন গুনমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। মোজার্ট তার বেশ কিছু কম্পোজিশনকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, প্রথম ভাগে (Exposition) মূল থিম বা ভাব এর সূচনা ঘটাতো আর পরের ভাগে(Development & Recapitulation) সেই থিম এর আরো সম্প্রসারণ, গভীরকরণ আর পুনরাবৃত্তি হতো। তার কম্পোজিশন গুলোর আধুনিক বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানতে পারি যে মোজার্ট তার এইসব কম্পোজিশন এর এই ভাগ গুলো সোনালী অনুপাত বজায় রেখে করতেন। Wolfgang-amadeus-mozart_1তবে এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, মোজার্ট কি এই ভাগ গুলো ইচ্ছা করে করতেন নাকি শুধু শ্রুতিমধুরতার জন্য করেছেন যা অবচেতনভাবেই কিংবা কাকতালীয়ভাবে এই সোনালী অনুপাত বজায় রেখেছে তা বোঝা মুশকিল।

তবে সঙ্গীত ছাড়াও সোনালী অনুপাতের প্রয়োগ রয়েছে জ্যামিতি, স্থাপত্যশিল্পে এবং চিত্রকলায়। এর ব্যবহার রয়েছে সোনালী আয়তক্ষেত্র (golden rectangle), সোনালী ত্রিভুজ (golden triangle), কেপলার এর ত্রিভুজ (Kepler’s Triangle). এছাড়াও গবেষকেরা এই অনুপাতের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন গ্রিক, মিসরীয়, সুমেরিয়ান, চাইনিজ, অলমেক, স্ক্যান্ডিনইভিয়ান স্থাপত্য, ভাস্কর্য, মৃত্শিল্পে। এমনকি এর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে ব্রোঞ্জ যুগের কারুশিল্পেও।

স্থাপত্যশিল্পে এই অনুপাত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই চলে আসে পিরামিড এর কথা। খুফুর পিরামিডের ভূমির ক্ষেত্রফল/এলাকা (৭৫৫-৭৫৬ ফিট) এর অর্ধেক এবং এর লম্ব সমদ্বিখণ্ডক(৬১২ ফিট) এর অনুপাত এই সোনালী অনুপাত। প্রাচীন মিসরীয় হিন্ড পাপিরাস (Rhind Papyrus) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তারা এই পিরামিড বানিয়েছিল ৩:৫ (৩-৪-৫ ত্রিভুজ) অনুপাতে, যা থেকে বলা যায় প্রাচীন মিসরিয়ানরাও এই অনুপাত সম্পর্কে অবগত ছিল। এছাড়াও খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে  গ্রিক দেবী এথেনার (Athena) জন্য বানানো পার্থেনন (Parthenon) মন্দির এর নির্মাণশৈলীতেও রয়েছে এর উপস্থিতি।  এই মন্দির এর নকশা করেন গ্রিক ভাস্কর ফিদিয়াস (Phidias), সোনালী অনুপাতকে প্রকাশ করার জন্য যে গ্রিক বর্ণ ফাই (Phi ɸ) ব্যবহার করা হয় তা এসেছে এই ফিদিয়াস এর নাম থেকেই। ফিদিয়াসের আরেক সমকালীন ভাস্কর পলিকলেইতস (Polykleitos) তার নানা ভাস্কর্যে ব্যবহার করেছেন এই অনুপাত। এর উপস্থিতি রয়েছে প্যারিসের নটর ডেম চার্চ, উত্তর আফ্রিকার কাইরুয়ান (Kairouan) মসজিদ, রোমের কোলোসিয়াম (Colosseum) এর নকশাতেও। এছাড়াও বর্তমানে অনেক নতুন স্থাপত্যেও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয় এই অনুপাত।

papyrus_rhindUnknownAn_exterior_view_of_the_Great_Mosque_of_KairouanColosseum-PicturesNotre-Dame-du-Sablon-side-entry2

 

ফ্র্যাক্টাল  (Fractals)

ফ্র্যাক্টাল হল বিশেষ ধরণের অ্যালগরিদমিক আর্ট যেখানে একই ধরণের প্যাটার্ন বার বার পুনরাবিত্তির মাধ্যমে কোন বিশেষ শেপ বা আকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। গত শতকের ৮০’র দশক থেকে এই ধরণের আর্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এই ধরণের আর্টগুলো ছোট কিংবা বড় করে যেভাবেই দেখা হোক না কেন সবসময় একই মনে হবে এবং এর প্রতিটা অংশকে আগের অন্য কোন অংশের পুনরাবিত্তি বলে মনে হবে। এই ধরণের আর্টের খুব ছোট একটি অংশ দেখতে যেমন দেখাবে এর বড় অংশটিও দেখতে ঠিক একি রকম দেখাবে। মূলত কম্পিউটার এর সাহায্যে এই ধরণের ছবি গুলো তৈরি করা হয় এবং এর নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্য সারা পৃথিবীতেই এটি বর্তমানে আর্টের খুব জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এছাড়া কম্পিউটারে ছবি আঁকার সময়ও এই আর্ট ব্যবহার করা হয়। যেমন কেউ যদি কম্পিউটারে ল্যান্ডস্কেপ আঁকার সময় মাঠ, গাছ, আকাশ ইত্যাদির জন্য ফ্র্যাক্টাল ব্যবহার করেন তবে সেই ছবি আমাদের চোখে আরো বেশি জীবন্ত এবং বাস্তব হয়ে ধরা দিবে। আর ফ্র্যাক্টাল আঁকার সময় বিভিন্ন গাণিতিক সুত্র ও সমীকরণ ব্যবহার করা হয়। বর্তমানকালে কম্পিউটারে ছবি আঁকতে ও অ্যানিমেশনের কাজে ফ্র্যাক্টাল এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। এরকম খুব জনপ্রিয় একটি ফ্র্যাক্টাল আর্ট হলো পেনরোজ টাইলস (Penrose Tiles) যা নামকরন করা হয়েছে বিখ্যাত ব্রিটিশ গণিতবিদ ও পদার্থবিদ রজার পেনরোজ এর নামে। তিনি এই টাইলিং নকশা তৈরিতে ব্যবহার করেছেন সোনালী অনুপাতকেও। আরো কিছু খুব জনপ্রিয় ফ্র্যাক্টাল আর্ট হলো জুলিয়া সেট (Julia Set), মানদেলব্রট সেট (Mandelbrot Set).

Penrose_Tiling.svg Julia_set_(ice) Mandel_zoom_00_mandelbrot_set

 

 চিত্রকলায় গণিত 

শিল্পকলায় অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে গণিতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হয়েছে চিত্রকলায় কিংবা ভিজুয়াল আর্টসে।

Alhazen

খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে ইউক্লিড তার অপটিক্স (Euclid’s Optics) গ্রন্থে দৃশ্যপটে (perspective) গণিতের ভুমিকা নিয়ে আলোচনা করেন এবং পরবর্তিতে আরবীয় গণিতবিদ আলহাজেন (Alhazen) ১০২১ সালে তার বুক অফ অপটিক্স (Book of Optics) গ্রন্থে এর আরো সম্প্রসারণ ঘটান।ইউরোপে রেনেসাঁর (Renaissance) সময় থেকে চিত্রকলায় গণিতের ব্যবহার বেড়ে চলে এবং তখনকার শিল্পীরা গণিতের প্রতি আরও বেশি করে আকৃষ্ট হয়ে উঠে। তারা উপলব্ধি করে যে মহাবিশ্বের সারমর্ম বোঝার একমাত্র ভাষা হলো গণিত। তারা ত্রিমাত্রিক বস্তুকে দ্বিমাত্রিক ক্যানভাস এ ফুটিয়ে জন্য জ্যামিতি নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে সবার প্রথমে উল্লেখ করতে হয় পিয়েরো দেলা ফ্রান্সেস্কার (Piero della Francesca) নাম। ইউরোপীয় রেনেসাঁর  প্রথম সারির আর্টিস্টদের মধ্যে তিনি একজন। malatestaতিনি একজন দক্ষ গণিতবিদও ছিলেন। এবং তাকে বলা হয় তার সময়কালের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্যামিতিবিদ। তিনি কাজ করে ছিলেন দর্শানুপাত বা দৃশ্যপট নিয়ে। তিনি আর্কিমিডিস আর ফিবোনাচ্চির কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং দৃশ্যপটের উপর তার কাজ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো S. Agostino Altarpiece ও The Flagellation of Christ. এছাড়াও তিনি  দৃশ্যপটের উপর গণিতের প্রভাব নিয়ে De Prospectiva Pingendi নামে একটি বই লিখেন।  তিনি উপলব্ধি করেন যে দৃষ্টিকোণ (point of view) পরিবর্তনের সাথে কোনো বস্তুর আকৃতির পরিবর্তনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট গাণিতিক সম্পর্ক রয়েছে। পিয়েরোর কাজ গুলো পরবর্তিতে তারই ছাত্র লুকা পাকিয়োলি (Luca Pacioli) এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (Leonardo da Vinci)  কে এ ব্যাপারে আরো আগ্রহী করে তুলে। লুকা ১৫০৯ সালে অনুপাতের উপর তিন খন্ডের De Divina Proportione বইটি প্রকাশ করেন।PieroDellaFrancescaScreen Shot 2014-10-11 at 11.18.59 PM

আর ভিঞ্চি তার বিভিন্ন কাজে জ্যামিতিক প্রতিসাম্যতা, সোনালী অনুপাত, সোনালী আয়তক্ষেত্র ইত্যাদির ব্যবহার করেছেন। মোনালিসা (Mona Lisa), দা লাস্ট সাপার (The Last Supper), ভিটরুভিয়ান ম্যান (Vitruvian Man) ইত্যাদি পেইন্টিং এ সোনালী অনুপাত ও দৃশ্যপটের বিশেষ ব্যবহার তার ছবি গুলোকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। ভিঞ্চি তার ড্রয়িংগুলোতে কৃত্তিম ও প্রাকৃতিক দুই ধরনেরই দৃশ্যপটই ব্যবহার করেন এবং এর পিছনের গাণিতিক গুরত্ব  নিয়ে অনেক গবেষণা করেন। Durer_selfporitraitতখনকার সময়ে দৃশ্যপট নিয়ে নিয়ে কাজ করা আরো উল্লেখযোগ্য কিছু আর্টিস্ট হলো আলব্রেক দুঃরের (Albrecht Dürer), গিয়ট্টো (Giotto), ব্রুনেলেসচি (Brunelleschi), আলবের্তি (Alberti).  ব্রুনেলেসচি সর্বপ্রথম ভানিশিং পয়েন্ট (Vanishing Point) আবিস্কার করেন আর আলবের্তি পরবর্তিতে এর গাণিতিক বৈশিষ্ট গুলো আরো বিস্তারিত আলোচনা করেন।

আধুনিক কালের আর্টিস্টদের মধ্যে সালভাদোর দালি (Salvador Dali) তার চিত্রকর্মগুলোতে সোনালী অনুপাতের ব্যবহার করেছেন। তার এরকম খুব জনপ্রিয় কাজগুলো  হলো The Sacrament of the Last Supper, Corpus Hypercubus, The Swallow’s Tail. এছাড়াও  ইসার (M.C. Escher) এর কথা বলতে হয় যিনি চিত্রকলার সাথে জ্যামিতিক কাঠামো নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন এবং এইসব বিষয় নিয়ে তিনি Alhambra Sketch, Circle Limit III, Three Intersecting Planes, High and Low  আঁকেন। তিনি তার চিত্রকর্মের মাধ্যমে অনেক জটিল গাণিতিক চিন্তা ও  ধারণা যেমন সর্পিলাকার কাঠামো, ইউক্লিডিয়ান স্পেস, হাইপারবলিক কাঠামো ইত্যাদি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি প্রতিসাম্যতা ও টেসেলেসন (tessellation) এর কাজের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।

অন্যান্য এরকম আরো চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে হামিদ নাদারির Aesthetic Appeal যেখানে নাদারি বিভিন্ন গাণিতিক চিহ্ন ও আকৃতির এক অনলাইন আর্কাইভ গড়ে তুলেছেন।  আর জ্যামিতিক কাঠামো নিয়ে কাজ করাদের মধ্যে আরও বিশিষ্ট দুইজন আর্টিস্ট হলেন পাবলো পালাজুয়েলো (Pablo Palazuelo) এবং পাওলো উকেলো (Paolo Uccello)

 

অনন্য 

শিল্পকলার অনন্য ক্ষেত্রে যেমন ভাস্কর্যেও রয়েছে গণিতের প্রয়োগ। ভাস্কর পলিকলেইতস এর কথাতো আগেই বলেছি। জ্যামিতিক কাঠামো নিয়ে কাজ করা এরকম আরো স্বনামধন্য কয়েকজন হলেন জন রবিনসন (John Robinson), হেলামান ফার্গুসন (Helaman Ferguson). রবিনসন বিখ্যাত তার Rhythm of Life, Gordian Knot, Bands of Friendship ইত্যাদি ভাস্কর্যের জন্য আর হেলামান তার The Eightfold Way ভাস্কর্যের জন্য। তারা দুজনেই তাদের কাজের দ্বারা বিভিন্ন গাণিতিক বস্তু ও চিহ্ন ত্রিমাত্রিক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন EightFoldWayColorOrig1gorknot

 

সাহিত্যেও রয়েছে গণিতের প্রভাব। ড্যান ব্রাউন (Dan Brown) আর ক্যাথেরিন নেভিল (Katherine Neville) এর মত লেখক-লেখিকারা তো তাদের বইগুলোতে আর্ট, গণিত, ক্রিপ্টোলোজি মিশিয়ে বেশকিছু খুব জনপ্রিয় সাসপেন্স- থ্রিলার ধরানার উপন্যাস রচনা করেছেন।  রয়েছে গণিতের উপর বেস্ট সেলিং বই যেমন Who We Are অথবা A Mind For Numbers. রয়েছে জুরাসিক পার্ক এর মত বিশ্ববিখ্যাত বই যেখানে গল্পের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর মধ্যে আছে একজন গণিতবিদ। এছাড়াও আছে লুইস ক্যারোল (Lewis Carroll) এবং এডউইন এবোট (Edwin Abbott) এর মত নামকরা গণিতবিদ যারা গল্পের বই লিখেও বিখ্যাত হয়েছেন। দস্তয়েভস্কি (Fyodor Dostoyevsky), তলস্তয় (Leo Tolstoy) এর মত বিশ্বখ্যাত লেখকেরা তাদের লেখায় গাণিতিক যুক্তি, ধারণার ব্যবহার করেছেন অহরহ। আরও আছে গণিত এবং গণিতবিদদের নিয়ে চলচ্চিত্র যেমন- A Beautiful Mind, Good Will Hunting, Agora, 21, Pi, The Imitation Game, Infinity, 21 Grams, The Bank, Enigma. আর প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যভট্ট, ব্রহ্মাগুপ্ত, ভাস্করাচার্যের মত গণিতবিদেরা তাদের গ্রন্থে বিভিন্ন গাণিতিক যুক্তি, তত্ত্ব, উপপাদ্য আলোচনা করেছিলেন ছড়া, শ্লোক আকারে।

 

গণিত কি নিজেই কোনো আর্ট হতে পারে ? অন্তত গণিতবিদদের কাছে কোনো সূত্রের প্রমাণ অথবা কোনো নতুন তত্ত্বের ব্যাখ্যা দাঁড়া করানো নতুন কোনো ছবি আঁকা কিংবা সুর তৈরী করবার মতই আনন্দদায়ক। গণিত তো নিজেই এক বিশাল শিল্পকর্ম যার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রহস্য গুলো বুঝতে পারছি, পারছি প্রকৃতির নিয়ম গুলো ধরতে। শূন্য থেকে অসীম পর্যন্ত নিয়মের যে সুশৃঙ্খল সমাবেশ তার আমরা পড়তে পারছি গণিতের ভাষায়। পিথাগোরাস থেকে মোজার্ট, ইসার থেকে ভিঞ্চি, লেখক, কবি, ভাস্কর সবাই এই গণিতের অনিন্দ সৌন্দর্যে আলোড়িত-আন্দোলিত হয়েছেন সজ্ঞানে কিংবা অবচেতনভাবে। সর্বত্রই রয়েছে গণিত অথবা বলা যায় গনিতেরই শাসন বিদ্যমান এই মহাবিশ্বের প্রতিটা বিন্দুতে। শিল্প আমাদের চারপাশের পরিবেশের যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলে সেই সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গণিতের যুক্তিতে। লেখা শেষ করবো গ্যালিলিওর একটি উক্তি দিয়ে– “The universe, which stands continually open to our gaze, but it cannot be understood unless one first learns to comprehend the language in which it is written. It is written in the language of mathematics, and its characters are triangles, circles, and other geometric figures, without which it is humanly impossible to understand a single word of it; without these, one is wandering about in a dark labyrinth.”

 

[এই লেখাটি জিরো টু ইনফিনিটির মাসিক গণিত বিষয়ক প্রকাশনা পাই জিরো টু ইনফিনিটি এর নভেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে]

MD. Tariqul Islam

Elephant Road, Dhaka, BD

Facebook    |    Twitter

Tariqul Dipu
Author: Tariqul Dipu

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/tariquldipu/2882/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

1 comment

  1. ভালো হয়েছে !

মন্তব্য করুন