আমাদের মঙ্গল যাত্রা

যখন থেকে সে কথা বলা শুরু করল, তখন থেকেই সে শুধু আমাকে বিভিন্ন জিনিস ব্যাখা করে বোঝাতো

এই উক্তিটা একজন গর্বিত মায়ের । কয়েকদিন আগে ফেসবুক ঘাটতে যেয়ে একটা ফটোগ্রাফীর পেজে পাওয়া । সন্তান সম্পর্কে মায়ের মুল্যায়ন একপেশে হলেও এখানে মা এর মুল্যায়ন এর বিপক্ষে বলার মত যুক্তি সম্ভবত এই পৃথিবীবাসীর পক্ষে সম্ভব নয় । কারণ এখানে তার সন্তান হচ্ছেন Elon Musk  । Bill Gates কিংবা Steve Jobs এর মত Elon Musk একজন প্রযুক্তিবিদ এবং উদ্যোক্তা । কিন্তু অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সাথে Elon Musk কে আলাদা করে রাখে তার আশাবাদী মন । সায়েন্স ফিকশন বইয়ে পড়া ফ্যান্টাসীতে ভরা মন যখন বাস্তববাদীতার সাথে মিলে যায় তখন আসলে সেই মনকে বিশ্লেষণ করার মত ক্ষমতা একজন সাধারণ লেখকের থাকে না । আমার পক্ষেও Elon Musk এর মননকে একটা ছোট্ট লেখায় বর্ণনা করা সম্ভব নয় ।

Elon Musk এর বড় হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকায় । বর্ণবাদবিরোধী যোদ্ধা নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ আফ্রিকা । ১০ বছর বয়সে প্রথম কম্পিউটার হাতে পাওয়া Musk তার প্রথম গেমটা বানান ১২ বছর বয়সে । যেটা তিনি আবার বিক্রি করে দেন । গেমটার ওয়েব ভার্সন এখনও আছে । ১৭ বছর বয়সে কানাডায় পড়াশুনা করতে যান কিন্তু সেখানে পড়াশুনা শেষ না করে আমেরিকায় University of Pennsylvania তে যান । সেখানে তিনি প্রথমে Economics এবং পরে Physics এর উপরে undergrad ডিগ্রী নেন । তারপর Stanford এ যান  Energy Physics এর উপর PhD করতে । তখন সবেমাত্র Internet নামের একটা অদ্ভুত জিনিস মানুষের মাঝে সাড়া জাগিয়েছে । Musk ও এই ইণ্টারনেটের প্রেমে পড়ে যান এবং PhD শুরুর ২ দিনের মাথায় PhD থেকে ড্রপ করেন । তার প্রথম Internet ভিত্তিক প্রোডাক্ট ছিলো Zip2 । ছোট্ট এই কোম্পানিটির প্রচারণা চালাত Musk এবং তার ভাই-  মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে । এটা ছিলো একটা ওয়েবভিত্তিক City Guide.

vlcsnap-2014-10-03-18h41m03s176

উপরের ছবিটা Musk এর Zip2 তে থাকাকালীন তোলা ছবি । খুব বেশি বর্ণনায় না গিয়ে এক কথায় বলা যায় Musk যখন zip2 কে ৩০৭ মিলিয়ন ডলারে বেঁচে দেন তখন তার ব্যাংক ব্যালান্স হয় ২২ মিলিয়ন ডলার । এই টাকা দিয়েই তিনি পরে অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে X.com খুলতে যান যা বর্তমানে PayPal নামে পরিচিত । এই পেপাল বিক্রীর টাকা থেকে Musk পান ১৬৫ মিলিয়ন । তারপর তিনি ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠা করেন SpaceX, Tesla Motors, Solar City এবং OpenAI । এছাড়া তার HyperLoop নামে আরো একটা প্রজেক্ট আছে – যা এখনও গবেষণার পর্যায়ে আছে ।  আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে SpaceX, যা কিনা কয়েকমাস ধরে খবরের শিরোনাম হয়ে আছে সফল ভাবে Re-usable rocket উদ্ভাবন করে । মহাকাশ যাত্রায় খরচের সিংহভাগ যায় রকেটের পিছনে । পৃথিবীর Gravity এর বাধা অতিক্রম করতে ব্যবহার হওয়া রকেটগুলো একবার ব্যবহারের পরই মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । SpaceX এর এই re-usable রকেট শুধু মিলিয়ন ডলার-ই বাঁচিয়ে দিচ্ছে না সাথে সাথে মানুষের মহাকাশ যাত্রার নতুন কিছু সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে । Musk এর মত মানুষের এটা বুঝতে বেশি সময় লাগে নি । তাই তিনি ২০২৫ এর মাঝে প্রথম মানুষ নিয়ে মঙ্গলযাত্রার ঘোষণা দিয়েছেন । তিনি পারবেন কি পারবেন না- সেটার উত্তর সময়ই বলে দেবে । কিন্তু আমরা যদি ধরে নেই Musk মানুষকে মঙ্গলে নিয়ে যেতে সফল হবেন – তারপর কী ঘটবে ? সায়েন্স ফিকশনের মত মঙ্গলে কলোনী গড়ে মানুষ সুখে থাকতে পারবে ? এই উত্তরটা খুব জটিল ।

শুধুমাত্র প্রযুক্তির অগ্রগতি দিয়ে মানুষকে বিবেচনা করলে ভুল হয় । মানুষের বাঁচার জন্য অনেক কিছু লাগে । শুধুমাত্র খাওয়া-পড়াই শেষ কথা নয়, মানুষ মুক্তভাবে কথা বলতে চায়, নিজের ভাব প্রকাশ করতে চায়, বাঁচার জন্য অনুপ্রেরণা চায় । এক কথায় তার একটা জীবন দর্শন লাগে । মঙ্গলের মত বন্দী পরিবেশে এমন মুক্ত মানব কিভাবে মানিয়ে নিবে ? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্যই আমি একটা অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে কথা বলব ।  Elon Musk এর জন্মের বছরেই এক অদ্ভুত রোগ নিয়ে পৃথিবীতে আসে David Vetter । SCID (Severe Combined Immunodeficiency) রোগে আক্রান্ত David এর শরীরে পৃথিবীর সাধারণ বাতাসে যেসব জীবাণু থাকে তার সাথে লড়াই করার মত শক্তি ছিলো না । তার বাবা-মা আগে একবার বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলো এবং সেই বাচ্চাও একই রোগে আক্রান্ত ছিলো । ডাক্তাররা বুঝতে না পারায় শিশুটি আলোর মুখ দেখার একটু পরই মারা যায় । David এর বাবা-মা আর সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । কিন্তু বিজ্ঞানীদের অনুরোধে SCID এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য তার বাবা-মা আবার বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং David পৃথিবীতে আসে । তাঁকে রাখা হয় জীবাণুমুক্ত এবং বায়ুরোধক একটা চেম্বারে । সেই চেম্বারের ভিতরি সে খেত, ঘুমাতো । তাঁকে কেউ সরাসরি স্পর্শ করতে পারত না । একটু বড় হওয়ার পর সে মহাকাশচারীদের মত অক্সিজেন স্যুট পরে কয়েক ঘন্টার জন্য বাইরে বের হতে পারত ।

1-00HdYya63KgHR8rqk4CsKw

কথা ছিলো কয়েক বছরের মাঝেই SCID এর কোন না কোন প্রতিষেধক বের করে ফেলবেন গবেষকরা । কিন্তু ক্রমাগত গবেষক পরিবর্তন হওয়ায় গবেষণার গতি কমে যায় অনেক ।  David এর বাবা-মায়ের এ নিয়ে অভিযোগের কমতি ছিলো না ।  David অন্য সব শিশুদের মত উচ্ছলভাবে খেলতে পারত না , চেম্বারের বাইরের জীবন ছিলো তার কাছে অদ্ভুত রহস্যময় । তাঁকে একবার গাছের ছবি আঁকতে দেওয়ায় সে গাছের উপরে পাতা এঁকেছিল বাক্সের মত করে । সে কোন মতেই বিশ্বাস করতে পারে নি যে গাছের পাতা সবুজ হতে পারে !  ১২ বছর বয়সে একটা ব্যর্থ অপারেশনের কারণে যখন সে ধুকছিলো তখন ডাক্তাররা তাঁর অনুরোধে তাঁকে চেম্বার থেকে মুক্ত করে দেয় । সে প্রথমবারের মত তাঁর মাকে ছুয়ে দেখে। তাঁর শেষ সময়ের বর্ণনা খুঁজতে গেলে এই কয়েকটা লাইন পেলাম –

“In February 1984, she visited David the day he’d been removed from his bubble. He was conscious and calm, and seemed to realize he was dying. Wearing surgical gloves, she touched him for the first time outside the bubble, helping him to sit up and adjust his surgical mask. They held hands.

From his hospital bed, he asked that the miniblinds be raised; he wanted to see the view from his new room. But instead of the expected sunset, the window revealed only a brick wall. Murphy began to cry.

For once, their roles were reversed: David tried to comfort Murphy, reminding her of the wall in a children’s book she used to read him. David had spent his whole life with barriers. This last one was hardly the worst.”


     এখানে David আর তাঁর মায়ের কথা বলা হয়েছে ।
        মঙ্গলে গেলেও মানুষকে David এর মত বাইরের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই থাকতে হবে । সেখানে এই সুজলা-সুফলা পৃথিবীর মত মুক্তভাবে মানুষ ঘুরে বেড়াতে পারবে না । বছরের পর বছর ধরে এভাবে থাকতে থাকতে মানুষের স্বাভাবিক বিবর্তনটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে ? এই প্রশ্নটা নৃতাত্ত্বিকরা করে আসছেন বেশ কিছুদিন ধরে ।
      কয়েকদিন আগে এক সাক্ষাতকারে Elon Musk বলেছেন , তাঁরা প্রথমে মঙ্গলে কার্গো পাঠাবেন । মোটামুটি কয়েকজন থাকার মত রসদ এবং পরিবেশ তৈরি হলেই সেখানে যাবে মানুষ । মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর চেয়ে এই ব্যাপারটাই বেশি চ্যালেঞ্জিং । হয়ত উন্নতমানের রোবোট পাঠানো হবে, যারা দুর্গম পরিবেশে মানুষের জন্য কাজ করে যাবে । কিন্তু মানুষের মানসিক ক্ষমতা কী আসলেই মঙ্গলে যেয়ে বছরের পর বছর ধরে বসবার করার মত শক্তি অর্জন করেছে?
   সবশেষে একটা মজার তথ্য দেই । Musk এর মায়ের নাম Maye Musk, যিনি কিনা দক্ষিণ আফ্রিকার একজন বিখ্যাত মডেল
Md. Noor Faizur Reza
Author: Md. Noor Faizur Reza

আমার যে কাজ ভালো লাগে তা নিয়ে সারাদিন পরে থাকি !

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/rezanur/4149/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

1 comment

  1. David Vetter এর স্টোরিটা ভালো লাগল। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ সবই করতে পারে। 🙂

মন্তব্য করুন