কোয়ান্টাম বকবক ০১ : শ্রোডিঙ্গার ইকুয়েশন

আরিফিন দিনদিন মোটা হচ্ছে দেখে স্রোষ্টা ভাবলেন, ব্যাটাকে একটু ছোট করে দেই। ওদিকে কোন বেয়াদব যেন সিস্টেমে বাগ ঢুকিয়ে রেখেছে, সুইচ চাপতেই আরিফিন ছোট হতে হতে একেবারে ইলেক্ট্রন প্রোটনের সাইজে চলে গেলো। পরের দিন সে যদি গণিত বিভাগে ক্লাস করতে আসে, তাহলে অমূল্য স্যার কিছুতেই বলতে পারবেননা যে আরিফিন পাঁচ নম্বর বেঞ্চিতে বসে আছে। তাঁকে বলতে হবে, আরিফিন পাঁচ, ছয় এবং সাত নম্বর বেঞ্চিতে ডিস্ট্রিবিউটেড হয়ে আছে। কারন আরিফিন পৌঁছেছে কোয়ান্টাম জগতে।

একটা প্রশ্ন দিয়ে আজকের গল্প শুরু করি। শক্তি কাকে বলে?

এরকম প্রশ্ন কেউ জিগেস করলে আসলে খুব অস্বস্তিতে পড়ে যাই। কারন, উত্তরটা আমার জানা নেই। বিভিন্ন উদ্ভট এবং ভটভট বাক্যে উত্তর বানিয়ে দেওয়াটা সহজ হলেও সত্যিকারের উত্তরটা সম্ভবত বেশ কঠিন। ছোটবেলায় শেখা “কাজ করার সামর্থ্যকেই শক্তি বলে B-) “- বাক্যটিও আমার কাছে এমনই একটি উদ্ভট বাক্য। প্রচন্ড ছেলেভোলানো। যাঁরা শক্তির সংজ্ঞা নিয়ে আমার মত অস্বস্তি বোধ করছেন, তাঁদের জন্য সুখবর। এই পোস্টটা শক্তি নিয়ে বকবক করার উদ্দেশ্যে নয়। শ্রোডিঙ্গার ইকুয়েশন তৈরি করার জন্য শক্তির কথা নিয়ে এলাম।

শক্তি নিয়ে বিভিন্ন অস্বস্তি থাকলেও, শক্তির নিত্যতা নিয়ে আমাদের একফোঁটা অস্বস্তি কারও নেই। ছেলেবেলায় শেখা “সিস্টেমে মোট শক্তির পরিমান ধ্রুব থাকে” – বাক্যটি মোটেই ছেলেভোলানো নয়। বরং এটিই শক্তি নিয়ে আমার জানা সবচে’ আরামদায়ক বাক্য। জটিলতা এড়াতে আপাতত শুধু যান্ত্রিক শক্তির দিকে তাকানো যাক, ইংরেজিতে যেটার নাম Mechanical Energy. বল দাও মোরে বল দাও এবং পজিশন ডিপেন্ডেন্ট ফোর্স নামের দুটো পোস্টে এসব নিয়ে অনেক গল্প হয়েছিলো। এই লিঙ্কেও শক্তি-ফক্তি নিয়ে বেশ প্যাচাল পেড়েছি। সময় হলে ঘুরে আসবেন। মোদ্দা কথা হল, একটা বস্তু দৌড়ের উপর থাকুক, আর চুপ করে বসে থাকুক, তার মেক্যানিক্স কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে আমরা একটা ম্যাথম্যাটিকাল কোয়ান্টিটি ধ্রুবক হিসেবে পাই। আমরা বলি, কোয়ান্টিটিটা কনজার্ভড। অর্থাৎ তার পরিবর্তন নেই। কিছু একটা নামে ডাকতে হয়, তাই নাম একটা দিয়ে দিয়েছিঃ শক্তি। আহা! আমাদের এই শক্তি জিনিসটার চকচকে কনজার্ভেশন ল’টাও ইকুয়েশনে লিখে ফেলা যাকঃ

\begin{eqnarray}
E &=& E_k + E_p \nonumber \\
&=& \frac{1}{2} m v^2 + V(x) \nonumber \\
&=& \frac{p^2}{2m} + V(x)
\label{eq:consvEnergy}
\end{eqnarray}
কেউ চোখ কুঁচকানোর আগেই বলে রাখি, $E_k, E_p$ হচ্ছে গিয়ে বস্তুর কাইনেটিক এবং পটেনশিয়াল এনার্জি, শেষ লাইনের $p=mv$ হল মোমেন্টাম, $V(x)$ টাও পটেনশিয়াল এনার্জি। পটেনশিয়ালের পজিশন ডিপেন্ডেন্স বোঝানোর জন্য ওভাবে লিখেছি। ভুলে গেলে এই পোস্টটিতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিন।

বস্তু, বস্তা, টেনিসবল, পাথর, ইট – এসবের ক্ষেত্রে শক্তির নিত্যতা (Conservation of energy) বেশ ভাল কাজ করে। এগুলো ক্লাসিকাল জিনিসপত্র। বা আরও ভাল ভাবে বললে, ম্যাক্রোস্কপিক জিনিসপত্র। প্রশ্ন হল, অতি পিচ্চি কনিকার ক্ষেত্রেও কি শক্তির নিত্যতাটা এরকমই? ইলেকট্রন, প্রোটন, কোয়ার্ক, হিগস’দের জগতে শক্তির ব্যাপারটা কেমন?

সে জগতে শক্তির নিত্যতাটা একই। তবে তাদের চলাফেরার ধরন গতি, বা মেক্যানিক্সটা আলাদা। তারা যে নিয়ম-নীতি অনুযায়ী হেলেদুলে চলা ফেরা করে, সেই নিয়ম-নীতির নাম কোয়ান্টাম মেক্যানিক্স। আমার বহুদিনের সখ, কোয়ান্টাম মেক্যানিক্সকে বর্গমূলে হিস্টোরিকালি ডেভলপ করা। কিন্তু জ্ঞানে কুলায়না, সময়েও কুলায়না। তাই ভাবলাম ইতিহাস পরে। সেই জগতে যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলোকে মানবজাতি কিভাবে বোঝার চেষ্টা করে, তা নিয়ে কিছু অন্তত লিখে রাখি। বোর, প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন, শ্রোডিংগার, হাইজেনবার্গ, ডিরাক, বর্ন সহ ১৯০০ থেকে ১৯৩০ এর মধ্যে যত ফিজিসিস্ট বর্তমান ছিলেন, তারা সবাই বেশ কিছু কারনে বুঝতে পেরেছিলেন যে পিচ্চি জগতের বেয়াড়া কনিকা গুলো ক্লাসিকাল মেক্যানিক্স মানেনা। তাই তাঁরা কোমর বেঁধে নেমে কোয়ান্টাম মেক্যানিক্স ডেভলপ করে ফেললেন (আইনস্টাইন বাদে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স তাঁর দু’চোখের বিষ)।

শ্রোডিঙ্গারকে গল্পের নায়ক বানিয়ে দেয়া যাক। শ্রোডিঙ্গার বললেন, মোমেন্টাম $\vec{p}$ কোয়ান্টাম জগতে হয়ে যাবে $-i\hbar\vec{\nabla}$. নিঃসন্দেহে $\vec{\nabla}$ আমাদের পরিচিত ভেক্টর অপারেটর যেটা দিয়ে গ্র্যাডিয়েন্ট, ডাইভার্জেন্স, হাবিজাবি বের করি। অর্থাৎ তিনমাত্রায়,
\begin{eqnarray}
\vec{\nabla} = \frac{\partial}{\partial x} \hat{i} + \frac{\partial}{\partial y} \hat{j} + \frac{\partial}{\partial z} \hat{k}
\end{eqnarray}

কিন্তু ব্যাপারটা কেমন খটোমটো হয়ে গেলনা? আমাদের চিরচেনা ভরবেগকে দুর্বোধ্য অপারেটর বানিয়ে দিলাম? তার সামনে আবার কমপ্লেক্স $i = \sqrt{-1}$ বসালাম! খটোমটো তো বটেই! ভ্রু আরও কুঁচকে যাবে এখনই। নাছোড়বান্দা শ্রোডিঙ্গার পিচ্চিকণিকাদের অবস্থান, শক্তি, কৌণিক ভরবেগ সব কিছুকে অপারেটর বানিয়ে দিলেন। এ-তো মহাঝঞ্ঝাট! পজিশন $x$ কে বানিয়ে দিলেন পজিশন অপারেটর $\hat{x}$. শক্তিকে বানিয়ে দিলেন $i\hbar \frac{\partial}{\partial t}$. পটেনশিয়াল এনার্জি হয়ে যাবে, পটেনশিয়াল-এনার্জি-অপারেটর! হ্যাট-ফ্যাট লাগিয়ে কাজ নেই, ওটাকে $V(x)$-ই রাখছি।

এবার একটা কাজ করি। শক্তির নিত্যতার সূত্রটিকে, অর্থাৎ ইকুয়েশন \eqref{eq:consvEnergy} ‘কে শ্রোডিঙ্গারের হেয়ালিপনা দিয়ে লিখে দেখি কেমন দাঁড়ায়! অর্থাৎ $E, p$ এবং $V$ কে শ্রোডিঙ্গারের কথামত অপারেটর বানিয়ে দেবঃ

\begin{eqnarray}
E &=& \frac{p^2}{2m} + V(x) \nonumber \\
\implies i\hbar \frac{\partial}{\partial t}
&\equiv &
\frac{\left( -i \hbar \vec{\nabla} \right)^2}{2 m} + V(x) \nonumber \\
\implies i\hbar \frac{\partial}{\partial t}
&\equiv &
\frac{-\hbar^2 }{2m} \nabla ^2 + V(x)
\label{eq:schrodEqHalf}
\end{eqnarray}

ইকুয়েশনটিকে এতীম-এতীম লাগছে। বামদিকেও অপারেটর ($\frac{\partial}{\partial t}$), ডানদিকেও অপারেটর ($\nabla^2$ এবং $V(x)$ )। কিন্তু তারা অপারেট করবে কার ওপর? একটা কিছু তো থাকতে হবে, অন্তত একটা ফাংশন.., যার উপর অপারেট করে তারা কিছু একটা রেজাল্ট দেবে!

চলুন ফাংশন বসিয়ে দেই। বাম দিকে টাইম-ডেরিভেটিভ, ডানদিকে স্পেস-ডেরিভেটিভ, আর $V(x)$ এর চেহারা তো আপাতত বলতেই পারছিনা। তাহলে নিরাপদ চয়েস হবে $x$ এবং $t$ এর একটা ফাংশন। নাম রাখা যাক $\Psi(x,t)$. তাহলে \eqref{eq:schrodEqHalf} এর দু’পক্ষে এই ত্রিশুলের মত দেখতে জিনিসটা জুড়ে দিলে দাঁড়াবে,

\begin{eqnarray}
\implies \quad
i\hbar \frac{\partial}{\partial t} \Psi(x,t)
&= &
\left[ \frac{-\hbar^2 }{2m} \nabla ^2 + V(x) \right]
\Psi(x,t)
\label{eq:schroedingerEq}
\end{eqnarray}

খেয়াল করুন, আমাদের ভাবনার দৌড় যদি এক মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে $\nabla = \frac{\partial}{\partial x} \hat{i}$. কিন্তু তিন মাত্রায় ভাবনা চড়ালে $\Psi$ এর ভেতরের $x$ টি কিন্তু একটা 3D ভেক্টর হিসেবে লিখতে হবে। আপাতত একমাত্রায়ই থাকি। যা হোক, উপরের বিদঘুটেদর্শন ইকুয়েশন \eqref{eq:schroedingerEq} -ই হচ্ছে ফিজিসিস্টদের অতি প্রিয় শ্রোডিঙ্গার ইকুয়েশন।

ইকুয়েশন তো হল, এখন এটার ইন্টারপ্রেটেশনটা কী? শ্রোডিঙ্গার ইকুয়েশনের ভেতর ওয়েভফাংশন নামে একটা জিনিস বসে আছে। সেটার ভেতরেই লুকিয়ে আছে ফিজিক্স। সে-ই কোয়ান্টাম জগতকে ইন্টারপ্রেট করে।

ওয়েভফাংশন

ঐ $\Psi(x,t)$ জিনিসটাই হচ্ছে গিয়ে ওয়েভফাংশন। এর বিশেষত্ব শুনলে হয় হেসেই উড়িয়ে দেবেন, নয়ত রেগে আগুন হয়ে যাবেন। ইন জেনারেল, $\Psi(x,t)$ ফাংশনটির ভ্যালু রিয়ালও হতে পারে, কমপ্লেক্সও হতে পারে। তাহলে, $\Psi^*\Psi = | \Psi | ^2 $ নিশ্চয়ই একটা রিয়াল এবং পজিটিভ নাম্বার। কোয়ান্টাম মেক্যানিক্স বলে, শ্রোডিঙ্গার ইকুয়েশনের সলিউশন $\Psi$ -এর জন্য, এই $| \Psi | ^2$ জিনিসটাই হচ্ছে একটা স্পেসে পার্টিকেলকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাব্যতা।

যাঁরা জিনিসটা বুঝতে পারছেন, তাঁরা নিশ্চিত জোরে জোরে না-সুচক মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। এসব আবার কোন পাগলের থিওরি রে বাবা! পার্টিকেলকে খুঁজে পাওয়ার আবার সম্ভাব্যতার কী আছে? একটা বাক্সের মধ্যে একটা পার্টিকেল পুরে রাখলাম। সে যে জায়গায় থাকবে, সেই জায়গায়ই থাকবে! এর মধ্যে আবার প্রবাবিলিটির কী হল?

না। “যে জায়গায় থাকবে, সে জায়গায়ই থাকবে” এরকম “লজিকাল” কথা বলার কোন সুযোগ নেই। ইন ফ্যাক্ট, বাক্সের মুখ খোলার আগে পার্টিকেলটি বাক্সের সব জায়গাতেই থাকবে। অনেকে ভাবছেন, তাহলে হয়ত ব্যাপারটা এরকমঃ পার্টিকেলটা কোন না কোন নির্দিষ্ট জায়গায় নিশ্চয়ই বসে আছে, আমরা তো বাক্স খোলার আগে ঠিক করে বলতে পারছিনা, তাই বলছি, ওমুক জায়গায় পার্টিকেলটা খুঁজে পাওয়ার প্রবাবিলিটি ওমুক, তমুক জায়গায় তমুক, ইত্যাদি…।

না। এরকম ডিটারমিনিস্টিক কায়দায় কোয়ান্টাম মেক্যানিকাল পার্টিকেলকে ব্যাখ্যা করা যায়না। এসব ক্লাসিকাল জিনিসপত্র বস্তু, বস্তা, ট্রাক, মারবেল – এসবের জন্য তুলে রাখুন। পার্টিকেলটি, বাক্সের সব জায়গায় লিটেরেলি ব্যপ্ত হয়ে আছে। যেই আমরা বাক্সের মুখ খুলব, ওমনি, কোন একটা জায়গায় পার্টিকেলটি লোকালাইজড হবে, এবং তার ওয়েভফাংশন কোল্যাপ্স করবে। এটাই এখন পর্যন্ত গ্রহনযোগ্য ইন্টারপ্রেটেশন। এটার একটা নামও আছে। কোপেনহাগেন ইন্টারপ্রেটেশন।

localization-of-wave-function

গাঁজাখুরি তত্ত্ব না? গাঁজাখুরি হলেও কোয়ান্টাম মেক্যানিক্স এক্সপেরিমেন্টালি ভেরিফাইড। বার বার হয়েছে, এবং প্রতিনিয়তই হয়ে চলেছে। আমি এক্সপেরিমেন্টের লোক না। এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে কিছুই জানিনা। তাই ওদিকে আর কথা বাড়াচ্ছিনা।

কেন ক্ষুদ্র জগতের কণিকারা এই অদ্ভুতুড়ে তত্ত্ব ফলো করে, মানবজাতির জানা নেই। অবশ্য, মহাবিশ্বের সবকিছুই যে মানুষকে জানানো হবে, তেমন ভাবারও কোন কারন নেই। এই বিরাট ব্রহ্মান্ডে অতি তুচ্ছ জ্ঞান নিয়ে মানুষের পক্ষে কতটুকুই বা আর জানা সম্ভব?

Keywords: Quantum mechanics, Schroedinger equation, wavefunction, wave function. 

Galib Hassan
Author: Galib Hassan

Mischief Managed.. 😉

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/kada-mati/4485/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

মন্তব্য করুন