রহস্যময় ফার্মেট থিওরি

গনিতের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত থিওরি হল ফার্মেটের লাস্ট থিওরি। শুধুমাত্র এই একটি থিওরি প্রমান করতে গিয়ে গত ৩শ বছরেরও বেশী সময় ধরে পৃথিবীর সেরা সেরা গণিতবিদেরা অক্লান্ত গবেষণা করে গেছেন। তাদের মধ্যে একজন ছাড়া কেউ ফার্মেটের লাস্ট থিওরি প্রমান করে যেতে পারেন নি। কেউ আবার ঐ থিওরিকে ভুল প্রমানে চেষ্টা করে গেছেন। শুধুমাত্র ঐ থিওরি প্রমান করতে গিয়ে আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন জার্মান গনিতবিদ পল উলফসকেহল। তিনি ছিলেন কারখানার মালিক এবং একই সাথে গনিতের এক নিভৃত সেবক। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে তিনি ফার্মেটের লাস্ট থিওরি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি যখন ব্যর্থ হলেন তখন হতাশায় ভেংগে পড়লেন। হতাশা এবং ব্যর্থতা থেকে মুক্তি পেতে তিনি আত্নহত্যার পথ বেছে নেন। আত্নহত্যার জন্য তিনি দিন ক্ষন ঠিক করলেন। ঠিক করলেন রাত ১২ টায় তিনি আত্নহত্যা করবেন। অবশেষে চলে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষন। কিন্তু ১২টার কয়েক মিনিট আগে তার মাথায় খেয়াল আসে আর একবার চেষ্টা করে দেখা যাক প্রমান করা যায় কিনা। অমনি লাইব্রেরিতে গিয়ে ফার্মেটের লাস্ট থিওরি নিয়ে  তখন পর্যন্ত যত গবেষনা করেছেন সেগুলোতে চোখ বুলানো শুরু করলেন। হঠাৎ থিওরি প্রমানের একটি উপায় পেয়ে গেলেন।  সংগে সংগে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি নতুন কৌশল নিয়ে ভাবতে বসে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হন। তার মানে এখন তাকে আত্নহত্যা করতে হবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সব কিছু দেখে নিলেন। এই সাজানো পৃথিবী ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে একজন ব্যর্থ গনিতবিদ হিসেবে। বিষন্ন মন নিয়ে টেবিল ছেড়ে আত্নহত্যার প্রস্তুতি নিলেন।  মাথায় পিস্তল তাক করে টিগারে আংগুল বসান। মাত্র একটি টিপ দিলেই ঘটে যাবে সমস্ত লেন্দেনের হিসাব। ব্যর্থ গনিতবিদ বলে তাকে আর কেউ অভিহিত করবে না। তিনি ফার্মেটের লাস্ট থিওরির কাছে আত্ন সমর্পণ করে চলে যাবেন চিরতরে। দেখে নিলেন ব্যর্থতার কালিমা লেপা এই পৃথিবীতে আর কতক্ষণ তিনি বেচে আছেন। কিন্তু ততক্ষনে সময় পেরিয়ে গেছে মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। আত্নহত্যার লগন পেরিয়ে গেছে। এখন কি করা!! অনেক ভেবে চিন্তে যখন উপায় পেলেন না তখন লগন পেরিয়ে যাওয়ায় আত্নহত্যার পরিকল্পনা বাদ দিলেন। বেচে গেল একটা জীবন। কিন্তু ফার্মেটের লাস্ট থিওরি প্রমানের ব্যর্থতার দায়মুক্তির জন্য তিনি একটা উইল করে যান এবং যিনি ভবিষ্যতে ঐ থিওরি প্রমান করতে পারবেন তার পুরষ্কার হিসেবে রেখে যান এক লাখ ডয়েস মার্ক( যা বর্তমানে ২০ লাখ ডলারের সমতূল্য)। পল উলফসকেহল ১৯০৬ সালে মারা যাওয়ার পর ঘোষনা করা হয় উলফসকেহল প্রাইজ। বলা হয় যিনি ঐ থিওরি প্রমান করতে পারবেন তিনি এই প্রাইজ পাবেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার প্রথম বছরেই কমিটিতে ৬২১ জন গনিতবিদ তাদের প্রমান হাজির করেন। কিন্তু তার একটিও শেষ পর্যন্ত টিকেনি। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার গনিতবিদ আই সাভান্ত ফার্মেটের লাস্ট থিওরি ভুল প্রমানের চেষ্টা করেন।

ফার্মেটের লাস্ট থিওরি :সপ্তদশ শতকে ফ্রান্সে জম্মগ্রহন করেন পিয়েরে দে ফার্মেট। একদিকে তিনি ছিলেন টলুজ পার্লামেন্টের একজন সদস্য,অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা এক গণিতবিদ। তিনি তার এক বইয়ে একটি থিওরি উল্লেখ করেছেন,যার চেহারা অনেকটা পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মত। পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি হল,

                                                        x2+y2=z2

পিথাগোরাসের এই সূত্রটির যদি কেউ সমাধান জানতে চান -এ সমীকরণের অখন্ড সংখ্যার(ইনটিজার)সমাধান কি? তাহলে বেশ কিছু উত্তর পাওয়া সম্ভব। যেমন –

                                             32+42=52                                                                                                                           অথবা

                                            52+122=132

এভাবে অনেক সমাধান পাওয়া যেতে পারে। ফার্মেট এর পর থেকেই শুরু করেছেন। তিনি দ্বিমাত্রিক ঐ সমীকরনের দুই মাত্রার পরিবর্তে তিন মাত্রা ব্যবহার করেন। যা হল

                                              x3+y3=z3

এখানে ফার্মেট প্রশ্ন উত্থাপন করেন -আপনি কি এই সমীকরনের সমাধান বের করতে পারবেন? এখানেই তিনি শেষ করেন নি। এই সমীকরনের মাত্রা বাড়িয়ে দেন –4,5,6,7,8,9,……n পর্যন্ত। ফলে ফার্মেটের সমীকরনের মূল চেহারা দাঁড়ায়-

                                                x3+y3=z3

                                               x4+y4=z4 

                                               x5+y5=z5

         …………………………………………………………………………..

        …………………………………………………………………………..

                                              xn+yn=zn

সব শেষে ফার্মেটের সূত্রকে বিবৃত করা হয়

                                              xn+yn=zn   এই আকারে ,যেখানে n>2.

এইটাই হল ফার্মেটের সেই লাস্ট থিওরি। ফার্মেট দাবী করে গেছেন এই সমীকরণটির কোন সমাধান নেই। তার এই দাবির পর সমীকরনটি পরিপূর্ণ প্রমান বা বা সমাধান আজও কোন গনিতবিদ দিতে পারেন নি। সমীকরণটি আবিষ্কারের পর কেটে গেছে ৩০০ বছরেরও বেশী। তারপরও এর সমাধান বের করতে না পারার কারণে পৃথিবীর গনিত ইতিহাসে এটি হয়ে আছে সবচেয়ে আলোচিত ,সব চেয়ে রহস্যময় এক সমীকরণ। ফার্মেটে যে বইয়ে তার লাস্ট থিওরি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার মার্জিনে লিখে গেছেন তার সমাধান। কিন্তু ঐ মার্জিনে লিখার মত জায়গা ছিল না।ফার্মেটের ভাষায়- এই প্রস্তাবনার চমৎকার একটি সমাধান আছে আমার কাছে। কিন্তু এই মার্জিন এত ছোট যে সেখানে লেখার মত জায়গা নেই।

এ কারনে ফার্মেট তার সেই চমৎকার প্রমান কোথাও লিখে যাননি। ফলে তার মৃত্যুর পর ইউরোপ সহ সারা পৃথিবীর গনিতবিদেরা উঠে পড়ে লাগে সেই থিওরি প্রমান করার জন্য। মূলত তখন থেকেই এর নাম হয়েছে “ফার্মেটের লাস্ট থিওরি”। সপ্তাদশ শতকের সেই থিওরি আজ গনিতের রহস্য হয়ে আছে। এখনও তা নিয়ে গবেষনা হচ্ছে। অনেক গনিতবিদ মনে করেন এর প্রমান সম্ভব না। তবে জর্জিয়ার গনিতবিদ আই সাভান্ত ফার্মেটের লাস্ট থিওরি তিন মাত্রা নিয়ে তার সমাধান বের করেছিলেন। এক রাতে তিনি ফার্মেটের থিওরি নিয়ে গভীর চিন্তা করতে করতে ত্রিমাত্রিক সমীকরনের সমাধান পেয়ে যান। এতে অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এবার বুঝি ফার্মেটের লাস্ট থিওরি মিথ্যা প্রমান হতে চলেছে। আই সাভান্ত যে সমাধান বের করেছিলেন তা হচ্ছে এরকম-

                      643+943=1033 , যেখানে আইডিওভেরিফিকেশন 0.0000915%

তার এই সমাধানের উপর ভিক্তি করে আরও কতগুলো সমাধান বেরিয়ে এসেছে। যেমন-

                                     543+1613=1633

                                    713+1383=1443

                                    733+1443=1503

                                   1283+1883=2063

                                   1353+1383=1723

এছাড়াও ফার্মেটের সমীকরন n=4,5,6,7 পাওয়ার পর্যন্ত সমাধান পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এ পর্যন্ত যে সমীকরণ গুলোর সমাধান পাওয়া গেছে সেগুলো হল

                                     x3+y3=z3

                                     x4+y4=z4 

                                     x5+y5=z5

                                    x6+y6=z6

                                    x7+y7=z7

ইমরান হোসেন
Author: ইমরান হোসেন

কি পারি আর কি পারি না নিজেই তা জানি না

Permanent link to this article: https://www.borgomul.com/imranhossain/572/


মন্তব্য করুন আপনার ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে

6 comments

Skip to comment form

  1. দারূণ লেখা !! ফার্মেটের লাস্ট থিওরী সম্পর্কে পড়তে যেয়ে মনে হচ্ছিল যেন মিথলজীর কোন গল্প পড়ছি।

    1. ধন্যবাদ 🙂

  2. ধন্যবাদ 🙂

  3. খুব ভাল লাগল ইমরান। তবে একটা কথা। আমার মনে হয়না, ফার্মা’র লাস্ট থিওরেম এখনও আনপ্রুভড। এটার প্রুফ ১৯৯৫ সালে Annals of Mathematics, 141 (1995), 443-551 -এ প্রকাশিত হয়ে গ্যাছে। অক্সফোর্ডের প্রফেসর এ্যান্ড্রু উইলস, তার ছাত্র রিচার্ড টেলর, এবং তাঁর কিছু প্রিন্সটোনের বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় প্রুফটি করেছেন। এই প্রুফের পেছনের গল্পটা বিরাট। আমি অবশ্য এ্যালজ্যাব্রাইক নাম্বার থিওরী নিয়ে কিছুই জানিনা। সুতরাং মডুলার থিওরেম, ইলিপ্টিক কার্ভস -এসব নিয়েও যুদ্ধ করতে পারবনা। তবে শুধু জানি, ফার্মা’র থিওরেমটা এখন প্রমানিত।

    এটা হল উইলসের পাবলিশড পেপারটির কপিঃ
    http://www.math.ethz.ch/~efonn/stuff/docs/fermat.pdf

    তুমি উইকিপেডিয়ার লিঙ্কটা দেখতে পারঃ
    http://en.wikipedia.org/wiki/Wiles's_proof_of_Fermat's_Last_Theorem

    1. ধন্যবাদ ভাইয়া , আমি শুধু আই সাভান্তের কথা জানতাম

  4. ভালো লাগল সারাজীবন এক পিথাগোরাস রে না দিয়া কিছু অংশ ফার্মারেও দেয়া উচিৎ 😛 😛 😀 😀

মন্তব্য করুন